কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি চট্টগ্রাম: দেশের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চল। তাই ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা আশঙ্কা রয়েছে। আবার এই অঞ্চলে আছে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা। দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিয়ে মানুষের মনে অজানা ভয় ভর করে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।

এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগেও নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম যোগাযোগপথ—টানেল—যাতে সুরক্ষিত থাকে, সে ব্যাপারে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম যোগাযোগপথ টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষে এখন যান চলাচলের অপেক্ষায় রয়েছে এই টানেল। আজ শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশের প্রথম টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর চীন সরকার দিচ্ছে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। চীন সরকার এই সহায়তা দিচ্ছে ঋণ হিসেবে।

এ ছাড়া টানেলের আগামী পাঁচ বছরের জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড। এ জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে ৯৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে চারটি স্ক্যানার কেনা ও স্থাপনের কাজে।

টানেল নগর প্রান্ত শুরু হয়েছে পতেঙ্গা এলাকা থেকে। আর শেষ হয়েছে আনোয়ারা উপজেলার সিইউএফএলের পাশ দিয়ে। দুই প্রান্তই সমুদ্রের কাছাকাছি। সমুদ্রের পাশে নির্মাণ করা হলেও ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় টানেল থাকবে সুরক্ষিত। আর ভূমিকম্প হলেও টানেলের স্থাপনার কোনো ক্ষতি হবে না। এমনটাই জানিয়েছেন টানেল নির্মাণের সঙ্গে দুই প্রকৌশলী।

প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের অবকাঠামো নির্মাণের সময় কত মাত্রার ভূমিকম্পসহনীয় হবে, তা বিবেচনায় আনা হয়। শূন্য দশমিক ২২ জি (ভূমিকম্প মাপার একটি একক) থেকে শূন্য দশমিক ২৮ জি মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে টানেলের অবকাঠামো।

রিখটার স্কেলে এর মাত্রা সাড়ে ৭। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুতে মাত্রা ধরা হয়েছিল শূন্য দশমিক ১৫ জি।

চট্টগ্রামে সহনীয় মাত্রা বেশি করার কারণ হিসেবে দুই প্রকৌশলী জানান, বঙ্গবন্ধু সেতু যেখানে নির্মিত হয়েছে, সে অঞ্চলের চেয়ে চট্টগ্রাম বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। অর্থাৎ এখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। তাই বিষয়টি নকশা প্রণয়নের সময় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলেও যাতে টানেলের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয়, সেদিকে তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে টানেলের ভেতরে পানি ঢুকতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় মোখার সময় সে নিরাপত্তাব্যবস্থার একটি মহড়াও দিয়েছিল টানেল কর্তৃপক্ষ।

পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের একেবারে কাছ ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। টানেলের গোলচত্বরের অবস্থান সৈকতের পাশেই।

ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় টানেলের নিরাপত্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফ্লাড গেট। টানেলের দুই টিউব বা সুড়ঙ্গে দুই প্রান্তে দুটি করে চারটি ফ্লাড গেট রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জলোচ্ছ্বাসের বিষয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হলে এই গেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। নেওয়া হবে নানা প্রয়োজনীয় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা। গেটগুলো বন্ধ রাখলে টানেলের ভেতরে পানি প্রবেশের সুযোগ নেই।

প্রকল্পের কাজে যুক্ত সেতু বিভাগের দুই প্রকৌশলী বলেন, টানেল নির্মাণের সময় শত বছরে হওয়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়। এই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল, তা–ও নকশা প্রণয়নের সময় গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখন যেভাবে নকশা করা হয়েছে, তাতে সৈকত থেকে পানি উপচে টানেলে আসার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। এরপরও যদি কোনো কারণে চলে আসে, তাহলে ফ্লাড গেটগুলো সুরক্ষা হিসেবে কাজ করবে।

এ ছাড়া টানেলের দুই প্রান্তে প্রবেশ ও বের হওয়ার মুখে বিশাল আকৃতির রেইন শেল্টার স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ঝড়বৃষ্টির সময় পানি এই আচ্ছাদনের ওপর দিয়ে বাইরে চলে যাবে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের সময় কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে, তার একটা বাস্তব মহড়া গত মে মাসে হয়। ওই সময় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা থেকে টানেলকে রক্ষায় বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দুই প্রান্তের ফ্লাড গেট। সর্তকতামূলক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে আরও ছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে জেনারেটর প্রস্তুত রাখা, ঘূর্ণিঝড়ের সময় নজরদারি দল (সার্ভিলেন্স টিম) প্রস্তুত রাখা, প্রকল্পে কর্মরত সবার এবং সম্পদ (জানমাল) রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত যানবাহনসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী (ক্রেন, এক্সকাভেটর, ডিভাইডার, পাইপ, টিন ইত্যাদি) নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘূর্ণিঝড়ে উদ্ভূত যেকোনো সমস্যা তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রাপ্ত নির্দেশনার আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ। অবশ্য ওই ঘূর্ণিঝড় পরে আর চট্টগ্রামের উপকূলে আঘাত হানেনি।