জয়া বার্লিন ও জ্যাকব বার্লিন দম্পতি রোববার দুপুরে বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তাঁদের তৈরি পণ্য জেলা প্রশাসককে উপহার দেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি বরিশাল: ভিনদেশের এক দম্পতি জয়া বার্লিন ও জ্যাকব বার্লিন ১১ বছর ধরে বাংলাদেশের সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়ে ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্বাবলম্বী করতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন নিভৃতে। নিজেদের জন্মভূমি আর সেখানকার স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ছেড়ে তাঁরা বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষের মায়ায় এখানে পড়ে আছেন পুরো পরিবার নিয়ে। তাঁরা দুজনই আমেরিকার নাগরিক।
এই দম্পতি ফরিদপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন পাঁচ সন্তান নিয়ে। সেখানে একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাসের পাশাপাশি পরিচালনা করছেন সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য একটি সেফ হোম। অ্যাকশন জয় এন্টারপ্রাইজ নামে এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী (সিইও) জয়া বার্লিন। আর স্বামী জ্যাকব বার্লিন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এই দম্পতি এখন এই কাজের পাশাপাশি দেশের ৬৪ জেলায় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সামাজিক প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং সরকারি শিশু পরিবারগুলোর অনাথ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অনুপ্রেরণা জোগাতে সচেতনতার কাজ শুরু করেছেন। একই সঙ্গে দক্ষতা, নেতৃত্ব, ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। গত শুক্রবার সন্তানদের নিয়ে এ কাজে তাঁরা বরিশালে এসেছিলেন। শনি ও রোববার দুদিন বরিশালের সামাজিক প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ও দুটি শিশু পরিবারের নিবাসে সঙ্গে কাটান। গান-আড্ডা, নৃত্য, প্রশিক্ষণ নানা কাজে অনুপ্রেরণা জোগান সুবিধাবঞ্চিত এসব মেয়ে ও শিশুদের।
বরিশালের সামাজিক প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘বিদেশি দম্পতি নিজেদের ইচ্ছায় আমাদের এসব কেন্দ্রে এসেছেন। তাঁদের উদ্দীপনামূলক কথা শুনে ও সৃজনশীল কাজ শিশু ও সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের ব্যাপক উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছে। রোববার দুপুরে এই দম্পতি সাক্ষাৎ করেন বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলামের সঙ্গে।’
এই দম্পতির পাঁচ ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তারাও বাবা-মায়ের সঙ্গে এ দেশেই আছে। তাদের নামও রাখা হয়েছে বাংলা ভাষার সঙ্গে সংগতি রেখে—হাসি (৮), খুশি (৬), আনন্দ (১১), মিষ্টি (৫) ও সুখী (২)।
রোববার বিকেলে বরিশালে জয়া বার্লিন কথা বলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে আসা, এ দেশের মানুষ, প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ এবং এখানে থিতু হওয়ার আদ্যোপান্ত জানান। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন তিনি।
২০১১ সালের দিকে জয়া বার্লিনের স্বামী জ্যাকব বার্লিন একটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে পটুয়াখালীতে এসেছিলেন এবং কয়েক মাস সেখানে কাটান। জয়া তখন আমেরিকার আলাস্কায় থাকতেন। ওই বছরই তাঁদের বিয়ে হয় এবং প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসেন জয়া। তখন কথা ছিল, চাকরির সুবাদে তাঁরা তিন বছর এ দেশে থাকবেন। কিন্তু কী এক অদ্ভুত মায়ায় পড়ে যান তাঁরা। এই দেশের প্রকৃতি ও মানুষের অপরিসীম দরদ তাঁদের মুগ্ধ করে।
জ্যাকব বার্লিন ও জয়া বার্লিন দম্পতি শনিবার দুপুরে বরিশালের সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে যান। সেখানে তাঁদের সন্তানেরা নৃত্য পরিবেশন করে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জয়া বার্লিন বলেন, ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ বোধ করতেন তিনি। সেই বোধ থেকেই তিনি দেশের একটি সেফ হোমে যান এবং সেখানকার মেয়েদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এই সূত্রে সেই সেফ হোমের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেখানে থাকা মেয়েদের অসহায়ত্বের গল্প শুনে তাঁর ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে ওঠে। তাদের জন্য কিছু করা, পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করেন। এর পর থেকেই তিনি একটু একটু করে এই কাজে লেগে পড়েন। এত বছরে তিনবার আমেরিকায় গেছেন। আবার ফিরে এসেছেন।
ফরিদপুরে ভাড়া বাড়িতে জয়ার প্রতিষ্ঠান চলে এখন। ২০ জন কর্মী তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন। সেখানে সামাজিক প্রতিবন্ধী ২২ জন মেয়ে আছে। তাদের পড়াশোনা, হাতের কাজ শিক্ষাসহ নানা কাজে দক্ষ করে তুলছেন। এই মেয়েরা অনেকে হস্তশিল্প তৈরি করছে। এ দেশে এসব পণ্য বিক্রির জন্য একটি শোরুম করার চিন্তা আছে জয়া-জ্যাকব দম্পতির। একই সঙ্গে ফরিদপুরে জমি কিনে ভবন করার পরিকল্পনাও আছে।
জয়া বলেন, ‘আমার চাওয়া খুব ছোট, তবে এর প্রভাবটা অনেক বড়। সেটা হলো, আমার সীমিত সামর্থ্য দিয়ে যদি একটি মেয়ের মুখেও হাসি ফোটাতে পারি, সেটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি যখন কোনো মেয়ের সামনে দাঁড়াই, তখন আমি তাদের বলি, আমি তোমাদের কোনো সাহায্য করব না, কিন্তু তোমাদের পাশে দাঁড়াব। আমরা প্রশিক্ষণের মধ্যে তাদের সুতা ও কাপড় দেব। যেখানে আঁকাবাঁকা সেলাই করে তারা কষ্ট-দুঃখ প্রকাশ করবে। দুঃখ লাঘব করতে করতে দক্ষ হবে এবং স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। আমি বিশ্বাস করি, এভাবেই একদিন এই মেয়েরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।’
জয়ার কাছে প্রশ্ন ছিল, তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? মুখভর্তি হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ‘অসহায় মেয়ে, বঞ্চিত শিশুদের মুখে হাসি ফোটানো, দুঃখমোচনের এই কাজকে আরও গতিশীল করাই আমার একমাত্র পরিকল্পনা এবং এটাকে আরও সম্প্রসারণ করা। এর বাইরে আর কোনো ভাবনা নেই।’