পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম | ছবি:সংগৃহীত |
প্রতিনিধি রাজশাহী: এক নারীর কাছে চারঘাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল আলমের সাত লাখ টাকা ঘুষ চাওয়ার ফাঁস হওয়া অডিওর সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই অডিওর একটি অংশে ওই আওয়ামী লীগ নেতার কণ্ঠ শোনা যায়। তাঁর নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রুবেল। তিনি চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও একই ইউনিয়নের হলিদাগাছী দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।
জাহাঙ্গীর আলমকে মঙ্গলবার পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় বলে ওই বিদ্যালয় একটি সূত্রে জানা যায়। একজন উপপরিদর্শক (এসআই) তাঁকে গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যান। পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ওসি মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে গত শনিবার বিকেলে রাজশাহীর পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন সাহারা খাতুন (২৮) নামের এক নারী। এর সঙ্গে ঘুষ চাওয়ার ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের কথোপকথনের একটি রেকর্ডও সংযুক্ত করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে অডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ওসি মাহবুবুলকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। যদিও ফাঁস হওয়া অডিওর বক্তব্য ‘এডিটেড’ (সম্পাদনা করা) বলে দাবি করেছেন মাহবুবুল আলম। তিনি সোমবার বলেছেন, তাঁরা উভয়ই মাদক ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তিনি কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে স্বাধীনভাবে চলতে দেন না। এই কারণে তাঁরা পরিকল্পনা করে এডিট করে ছেড়ে দিয়েছেন।
এ ঘটনায় গত রোববার একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও করে দিয়েছেন পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আজ ছিল তদন্তের তৃতীয় দিন।
এদিকে অভিযোগকারী চারঘাটের শলুয়া ইউনিয়নের চামটা গ্রামের বাসিন্দা সাহারা খাতুনকেও মঙ্গলবার বিকেলে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে জানিয়েছিলেন, তিনি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অপেক্ষা করছেন।
ফাঁস হওয়া অডিওতে জাহাঙ্গীর আলমকে ওসি মাহবুবুল আলমের কথার সঙ্গে সুর মেলাতে শোনা যায়। একটি অংশে ওসি রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের বিষয়ে বলেন, ‘এক মন্ত্রী বাদে কারও কথা শুনতে এখানে আসি নাই।...এই লোকটা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে সম্মান করি। মন্ত্রী মানেই রাষ্ট্র। আর মন্ত্রী অত্যন্ত ভদ্রলোক মানুষ। আমাকে নিয়ে আসছে সে। আমাকে গাইবান্ধা থেকে নিয়া আসছে। তাহলে আমি যদি খারাপ হই, তাহলে কষ্ট পাবে।’ এই কথার মধ্যেই ওই আওয়ামী লীগ নেতা বলতে থাকেন, ‘আপনাকে নিয়া আসছে একেবারে নির্বাচনটা পার করে দিবেন...।’ জবাবে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘তা তোমাদের রিজিকে আছে কি না, আমি জানি না। এখন এই যে নির্বাচন কমিশনার নাটক শুরু করেছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আজ রাতে জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে বলেন, ওই দিন ওসির ওখানে উপস্থিত থাকার কারণে তাঁকে চারঘাট সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার প্রণব কুমার ডেকেছিলেন। পরে একটি গাড়িতে করে তিনি থানায় যান। সেখানে গিয়ে সেদিনের বিস্তারিত বলে তিনি চলে আসেন।
ওই দিনের অডিওর বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি সেখানে শুরুর দিকে ছিলাম। পরে কী হয়েছে না হয়েছে, জানি না। আমি নিচে চা খেতে নেমে আসি। পরে রাতে শুনি ফাঁস হওয়া অডিও। সেখানে শুরুতে আমার কথা আছে। কিন্তু পরে আর নেই।’ নির্বাচন প্রসঙ্গটা তাঁর বক্তব্য বলে তিনি স্বীকার করেন।
পুলিশ সুপারের করা তদন্ত কমিটির সদস্য প্রণব কুমারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ওই অডিওতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে তদন্ত কমিটি তথ্য নিচ্ছে। এটা অন্য কিছু নয়।
ফাঁস হওয়া ওই অডিওর বিষয়ে সোমবার প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি মুঠোফোনে এক খুদে বার্তায় বলেছেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার কোনো নিয়োগে আমি সুপারিশ করি না। যত দূর মনে পড়ে, তিনি যোগদান করেছেন অনেক দিন আগেই এবং অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার জন্য কয়েক দফা কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত ছিলেন বলে শুনেছি।’
লিখিত অভিযোগে সাহারা খাতুন উল্লেখ করেছেন, তাঁর স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। তাঁর স্বামীর দেওয়া তথ্যে চারঘাট এলাকায় অনেক মাদক কারবারিকে র্যাব ও পুলিশ আটক করেছে। এতে তাঁর স্বামী ও পরিবারের ওপর চারঘাটের মাদক ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হন। তাঁর স্বামীকে মাদক ও অস্ত্র দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর মাদক ব্যবসায়ীরা তাঁদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ওসিকে ফোন দিয়ে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। ওসি তাঁকে পরদিন থানায় আসতে বলেন। থানায় গেলে ওসি পাশেই তাঁর কোয়ার্টারে ডেকে নেন তাঁকে। এ সময় তাঁর ছেলেও সঙ্গে ছিল। ওসি তাঁর সঙ্গে যেসব কথা বলেন, তা তিনি কৌশলে রেকর্ড করে রাখেন।