যুক্তরাজ্যের ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী যে মেয়েরা এইচপিভি টিকা পেয়েছে, তাদের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যানসার আক্রান্তের হার ৯০ শতাংশ কমেছে। |
নাজনীন আখতার, ঢাকা: জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভি টিকা দেওয়া শুরু হচ্ছে আগামী ৪ অক্টোবর। ওই দিন রাজধানীর আজিমপুর গার্লস স্কুলে এ টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন হবে। এর আওতায় ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী; অর্থাৎ পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েশিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে এক ডোজ করে টিকা পাবে। এটি পরিচালনা করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)। এর আগে জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন স্কুল থেকে কিশোরীদের তথ্য নেওয়া হয়।
ইপিআইয়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এস এম আবদুল্লাহ আল মুরাদ বলেন, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) বাংলাদেশকে ২৩ লাখ টিকা দিয়েছে। প্রথম দফায় ঢাকা বিভাগের সব স্কুলের কিশোরীদের টিকা দেওয়া হবে। ২০ লাখের মতো কিশোরীকে টিকা দেওয়া হবে। আরও টিকা পাওয়ার পর আগামী বছরের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে এবং পরে আগস্টে বাকি পাঁচ বিভাগে টিকা দেওয়া হবে।
এর আগে ২০১৬ সালে সরকারিভাবে গাজীপুরে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০ হাজারের মতো ১০ বছর বয়সী মেয়েশিশুকে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভি টিকা দেওয়া হয়েছিল। ছয় মাসের মধ্যে দুই ডোজ টিকা দেওয়ার মাধ্যমে পাইলট প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেলেও এইচপিভি টিকা কর্মসূচিটি আর বিস্তৃত হয়নি। এরপর ২০২১ সালের ১২ মার্চ এইচপিভি টিকার জন্য গ্যাভি বাংলাদেশকে অনুমোদন দেয়। গত বছরের জুলাইয়ে দেশজুড়ে এইচপিভি টিকা কর্মসূচি শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও হয়নি।
জরায়ুমুখের ক্যানসারের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ৯০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনা; ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে অন্তত দুবার স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা এবং ৯০ শতাংশকে চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছে।
হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী একটি ভাইরাস। ইপিআই থেকে জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হালনাগাদ সুপারিশে এক ডোজ এইচপিভি টিকাই কার্যকর বলে জানানো হয়েছে। এক কোটির বেশি কিশোরীকে লক্ষ্য রেখে টিকার কার্যক্রম শুরু করা হবে।
২০২১ সালে ক্যানসারবিষয়ক গবেষণার অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ক্যানসার রিসার্চ ইউকে জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী যে মেয়েরা এইচপিভি টিকা পেয়েছে, তাদের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যানসার আক্রান্তের হার ৯০ শতাংশ কমেছে।
জরায়ুমুখ ক্যানসারের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে ঘন সাদা স্রাব, অতিরিক্ত রক্তস্রাব ও অনিয়মিত রক্তস্রাব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির সবশেষ ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন অনুসারে, জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বছরে নতুন করে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২৬৮ জন এবং বছরে মারা যান ৪ হাজার ৯৭১ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অল্প বয়সে বিয়ে, বেশি সন্তান, ঘন ঘন সন্তান ধারণ, অপুষ্টি দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন মেলামেশা থেকে জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান (নিপসম) ২০২০ সালে ‘ন্যাশনাল স্টেপস সার্ভে ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ রিস্ক ফ্যাক্টরস ইন বাংলাদেশ ২০১৮’ শিরোনামের প্রতিবেদনে জানায়, জরায়ুমুখের ক্যানসার আক্রান্ত কি না, তা জানতে জীবনে একবার পরীক্ষা করেছেন ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৪ শতাংশের কিছু বেশি নারী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অনকোলজি ভবনের ছয়তলায় স্থাপিত জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বিনা মূল্যে ভায়া (ভিজুয়্যাল ইন্সপেকশন অব দ্য সারভিক্স উইথ অ্যাসেটিক অ্যাসিড) পরীক্ষা করা হয়। কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী ২০ শতাংশ নারীকে ভায়া পরীক্ষার আওতায় আনা গেছে।
জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অধীন
‘ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার
পরীক্ষা কর্মসূচির’ প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আশরাফুন্নেসা
বলেন, কিশোরীদের টিকা দিলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার
প্রতিরোধ হতে পারে। তবে সম্পূর্ণ ঝুঁকি এড়াতে ওই কিশোরীদের ৩০ বছরের বেশি
বয়স হলে অবশ্যই ভায়া পরীক্ষা করা উচিত। এ ছাড়া ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী
নারীদেরও ভায়া পরীক্ষা করা উচিত। কারণ, ভায়া পরীক্ষার মাধ্যমে একজন নারীর
জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা ১০ বছর আগে শনাক্ত করা সম্ভব।
ফলে কারও জরায়ুমুখ ক্যানসার হলে তা আগেভাগেই শনাক্ত হবে এবং দ্রুত চিকিৎসা
শুরুর মাধ্যমে নির্মূল করা সম্ভব হবে।