স্বামীর মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী রত্না রানী শীল। পাশে তাঁদের মেয়ে ভূমিকা রানী শীল। পপুলার হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত ভুবন চন্দ্র শীলের জ্ঞান ফিরবে, এমন আশা ছিল স্ত্রী রত্না রানী শীলের। সেই অপেক্ষাতেই এক সপ্তাহ ধরে মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীলকে নিয়ে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের সিঁড়িতেই বেশির ভাগ সময় কেটেছে রত্নার। কিন্তু ভুবনের জ্ঞান ফেরেনি। সোমবার সকালে চিকিৎসক জানিয়ে দিলেন, আর কখনোই ভুবনের জ্ঞান ফিরবে না।
দুপুরে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালের দোতলায় গিয়ে দেখা যায়, মেয়ে ভূমিকা রানী শীলকে জড়িয়ে ধরে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীল। অপেক্ষা করছেন স্বামীর লাশ বুঝে পাওয়ার। কাছে গিয়ে কথা বলতেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ভুবনকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণা করলেন। কথা বলার একপর্যায়ে স্বামী হত্যার বিচার চাইলেন।
স্বামী হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে রত্না রানী শীল বলেন, ‘কে গুলি করেছে, জানি না। আমার স্বামী তো চলেই গেল। যারা গুলি করেছে, তাদের বিচারটা যেন হয়। একটাই চাওয়া, এভাবে আর কোনো সন্তানের বাবাকে যেন এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে যেতে না হয়। আমার মেয়েটা বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। আজ তার বাবা নীরবে চলে গেল। আমার মেয়েটা এত অভাগা, তার ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না।’
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে প্রাইভেট কারের আরোহী শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইদ মামুনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় একদল সন্ত্রাসী। সেই গুলি লেগেছিল মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। কাজ শেষে তিনি গুলশানের অফিস থেকে ভাড়ার মোটরসাইকেলে মতিঝিলের আরামবাগের বাসায় ফিরছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে ওই রাতেই তাঁকে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। গত শনিবার তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। আজ সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে তিনি মারা যান। পরে তাঁর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছ। রাতেই ভুবনের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজীতে নেওয়া হবে।
‘বাবার সঙ্গে তীর্থস্থান ঘুরতে যাওয়া হলো না মেয়ের’
ভুবন চন্দ্র শীল গুলশানে গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর স্ত্রী রত্না রানী শীল মাইজদীর একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুজনের কর্মস্থল আলাদা হওয়ার কারণে ভুবন ঢাকায় থাকতেন। আর স্ত্রী রত্না সদ্য এসএসসি পাস করা একমাত্র সন্তান ভূমিকাকে নিয়ে থাকেন নোয়াখালীর মাইজদীতে।
পপুলার হাসপাতালে রত্নার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি বারবার বলছিলেন, ‘বাবার সঙ্গে তীর্থস্থান ঘুরতে যাওয়া হলো না মেয়েটার।’ ভূমিকা তখন মাকে বারবার বলছিল, ‘আমরা ঘুরতে যাব, বাবার আত্মা সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকবে।’
রত্না রানী শীল জানান, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের চেন্নাইয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাঁদের। এক সপ্তাহ চিকিৎসার জন্য চেন্নাই থেকে বিভিন্ন তীর্থস্থানে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বাবা হাত ধরে তীর্থস্থানে মেয়েকে নিয়ে ঘুরবে, এ নিয়ে কত যে পরিকল্পনা ছিল ভুবনের। প্রতিদিন মুঠোফোনে মেয়ের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতেন তিনি। মেয়ে বাবার হাত ধরে ঘুরতে পারবে না, এটা যে কত কষ্টের, বোঝানো সম্ভব নয়।
গত মে মাসে চিকিৎসার জন্য রত্নাকে নিয়ে চেন্নাই গিয়েছিলেন ভুবন। তখন মেয়ে ভূমিকার এসএসসি পরীক্ষা ছিল। এ কারণে তখন সে সঙ্গে যেতে পারেনি। এবার মেয়ে যাবে বলেই ভুবন অনেক বেশি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলেও জানান রত্না। তিনি বলেন, মেয়ে এসএসসি পাস করার পর মুঠোফোন কিনে দিলেন বাবা ভুবন। মুঠোফোন কিনে দেওয়ার পর সারাক্ষণই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। দুজনে মিলে কতশত পরিকল্পনা যে করতেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। মায়াপুর, দক্ষিণেশ্বর ও দার্জিলিং গিয়ে কখন কোথায় থাকবেন, কী করবেন—সবকিছুই দুজনে মিলে পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। এখন তো সবই শেষ।
‘বাবা খাসির মাংস খেলেই আমাকে ফোন করত’
বাবা নেই, এটি যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না ভুবন চন্দ্র শীলের মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীল। পপুলার হাসপাতালে তার সঙ্গে কথা বলার সময় সে শুধু বাবার স্মৃতিচারণাই করছিল। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে চিকিৎসক হবে। কিন্তু মেয়ে চিকিৎসক হতে চায় না। সে ব্যবসায়ী হতে চায়। বাবাও মেয়ের ইচ্ছাকেই মেনে নেন। ভূমিকা বলছিল, ‘আমি ব্যবসা করব, এ নিয়ে বাবার সঙ্গে অনেক পরিকল্পনা হতো। শাড়ির ব্যবসা করা যায় কি না, এ নিয়ে যে কত গল্প হতো বাবার সঙ্গে।’
ভূমিকা বলে, ‘আমি খাসির মাংস খেতে পছন্দ করি। তাই বাবা যখনই খাসির মাংস খেতেন, আমাকে ফোন করে বলতেন, মা তোকে রেখেই আজ মাটন খেয়েছি। তখন আমি বলতাম, তুমি আমাকে রেখে কেন মাটন খেলে? আমি এখন বাবাকে রেখে কীভাবে মাটন খাব?’
এক সপ্তাহেও ধরা পড়েনি সন্ত্রাসীরা
ঢাকার রাস্তায় এভাবে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ার ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এ ঘটনায় ভুবন চন্দ্র শীলের স্ত্রী তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাত-আটজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে মামলাও করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। যদিও পুলিশের ধারণা, শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনকে (৫৪) লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের লোকজন। ওই গুলি লেগেছিল ভুবনের মাথায়।
পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) আরিফ রাইয়ান বলেন, গুলির ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
পুলিশ বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও তারিক সাঈদ মামুন একসময় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তাঁদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তাঁরা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি।