আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি | ফাইল ছবি |
রোজিনা ইসলাম, ঢাকা: গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাধবীলতা সেল। এই সেলেই থাকেন স্বামী রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। তাঁর সঙ্গে ওই সেলে থাকেন আরও দুই ফাঁসির আসামি। তেমন কোনো কাজ দেওয়া হয় না তাঁদের। কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের দিন কাটে কনডেম সেলে (নির্জন প্রকোষ্ঠে) শুয়ে, বসে আর প্রার্থনা করে।
২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজ এলাকায় দিনদুপুরে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন তাঁরই পরিচিত একদল তরুণ। হাসপাতালে নেওয়ার পর রিফাত মারা যান। তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা শুরুতে মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন। পরে তাঁকেও আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়। রিফাত হত্যা মামলায় ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রায় দেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ। বিচারিক আদালতের রায়ে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে আয়শা সিদ্দিকাসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা করা হয়।
আয়শার মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আমরা জামিনের আবেদন করব।’
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, আয়শার বাবা–মা বরগুনায় থাকেন। বাড়ি দূরে হওয়ায় তাঁরা মিন্নির সঙ্গে দেখা করতে তেমন একটা আসেন না। জানতে চাইলে আয়শার বাবা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আমি বয়স্ক মানুষ, মেয়েটা অসুস্থ। কিন্তু এত দূরে মেয়েকে দেখতে যেতে পারি না। মেয়ে তাই বরিশাল কারাগারে আসার আবেদন করেছিল। বোধ হয় আসতে দেবে না।’
আয়শার পাশের কক্ষেই থাকেন ২০১৯ সালের আলোচিত ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কামরুন্নাহার মণি ও উম্মে সুলতানা পপি। তাঁরা দুজনই নুসরাতের সহপাঠী ছিলেন।
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর চার দিন পর ১০ এপ্রিল ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়। নুসরাত হত্যা মামলায় কামরুন্নাহার ও উম্মে সুলতানাসহ ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
নুসরাত হত্যার সময় পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন কামরুন্নাহার। কারাগারেই তিনি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। তাঁর মেয়ে মুবাশ্বিরা খানের বয়স এখন চার বছর। কামরুন্নাহারের মা নুরুন নাহার বলেন, ছয় মাস আগে মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন। চার বছরের মুবাশ্বিরাকে নিয়ে খুব চিন্তিত জানিয়ে নুরুন নাহার বললেন, ছয় বছর পর যখন কারাগারে এই শিশুকে রাখা যাবে না, তখন তাকে কে দেখবে। তারা উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন বলেও জানালেন তিনি।
অন্যদিকে উম্মে সুলতানার বাবা শহীদুল ইসলাম বলেন, গত ঈদুল আজহার আগে মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন। যাতায়াতে অনেক খরচ হওয়ায় নিয়মিত যেতে পারেন না।
কামরুন্নাহার ও উম্মে সুলতানা দুজনই কারাগারে নিজেদের ইচ্ছায় সেলাই ও কুরুশের কাজ করেন বলে জানিয়েছেন কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্মকর্তারা।
ফাঁসির আসামিদের মধ্যে আরও আছেন ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি গৃহকর্মী রীতা আক্তার ও রুমা ওরফে রেশমা। মাহফুজা চৌধুরী হত্যা মামলায় ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের সুকন্যা টাওয়ারের বাসায় খুন হন মাহফুজা চৌধুরী। গৃহকর্মী রিতা ও রুমা পরস্পর যোগসাজশে তাঁকে হত্যা করে বাসা থেকে ২০ ভরি সোনা, একটি মুঠোফোন ও ৫০ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন মাহফুজা চৌধুরী।
এ ছাড়া এক গৃহবধূ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আনোয়ারা বেগম আছেন কনডেম সেলে। ২০০৫ সালের ২৬ মে রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে যৌতুকের জন্য আয়েশা বেগম নামের এক নারীকে বেধড়ক মারধর করেন তাঁর স্বামী ইব্রাহিম খলিল, ভাশুর (ইব্রাহিমের ভাই) আবদুল মিয়া ও ননদ আনোয়ারা বেগম। হত্যার পর আসামিরা আয়েশার লাশ বাড়ির পশ্চিম পাশের ধানখেতে ফেলে রাখেন।
এই পাঁচজনসহ বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত ৩৪ বন্দী কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছেন। তাঁদের অনেকের মামলা নিয়ে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। আবার অনেকের ডেথ রেফারেন্স নিয়ে আপিল করেছেন। সেটা আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
আদালত সূত্র জানায়, বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন নিতে হয়, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হিসেবে পরিচিত। হাইকোর্টের রায়ের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করতে পারে। আর আপিলে আসা সিদ্ধান্তের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষেরও আবেদন করার সুযোগ আছে। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। পেপারবুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের বক্তব্য, বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার তথ্যাদি থাকে।
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক এ এস এম আনিসুল হক জানান, কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ৩৪ জনসহ মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত নারী আসামির সংখ্যা ৭৬ জন। আর মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত মোট আসামি ২ হাজার ৪২২ জন।
দেশের ইতিহাসে বহু নারীর মৃত্যুদণ্ড হলেও এখনো কারও মৃত্যুদণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হয়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শকেরা জানান, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া নারী আসামিরা সকালে, দুপুরে ও বিকেলে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার জন্য কনডেম সেলের আঙিনা পর্যন্ত যেতে পারেন, তবে কারাগারে ঘুরে বেড়াতে পারেন না। মাসে একবার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া মুঠোফোনে সপ্তাহে একবার কথা বলতে পারেন। কেউ চাইলে কক্ষে বসে সেলাইয়ের কাজ করতে পারেন। তবে বেশির ভাগই সময়ই কাটান শুয়ে-বসে। তাঁদের জন্য সার্বক্ষণিক পাহারা থাকে।
কারা সূত্রে জানা গেছে, কনডেম সেলে সাধারণত একজন বা তিনজন বা পাঁচজন অর্থাৎ বেজোড় সংখ্যায় বন্দী রাখা হয়। কনডেম সেলে একটি ছোট জানালা থাকে। কারাবিধি অনুযায়ী ৩৬ বর্গফুট স্থান বরাদ্দ থাকতে হবে একজন বন্দীর জন্য। তবে কোথাও কোথাও সেল বড়ও হয়।
কারা কর্মকর্তাদের মতে, মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হওয়া এসব আসামিকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে রাখার ফলে তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক আসামির জন্য অর্ধেকের বেশি কারারক্ষীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে তাঁরা অন্য আসামিদের দেখাশোনা করতে পারেন না। আবার কোনো কোনো মামলার ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজা উচ্চ আদালতে কমে যেতেও পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।