চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের কেন্দুয়ার আমচাষি রফিকুল ইসলামের বাগানে থোকা থোকা ঝুলছে ‘মায়াভোগ’ আম। বৃহস্পতিবার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি চাঁপাইনবাবগঞ্জ: সব আমের যখন শেষ, তখন এর শুরু। স্বাদে-গন্ধে, গুণে–মানে সব দিক দিয়েই অতুলনীয়। আমের রাজ্যে পাওয়া নতুন একটি নাবি জাতের আম সম্পর্কে এমনই পছন্দের কথা জানালেন এক দল কৃষিবিদ ও আমবিজ্ঞানী।
তাঁদের মতে, আমটি নাবি জাতগুলোর মধ্যে আরও নাবি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে নাবি জাতের মধ্যে আশ্বিনা আমকে ধরা হয় সবচেয়ে নাবি জাতের। সেই আশ্বিনার যখন শেষ, তখন এই নতুন আমের শুরু। মৌসুম দীর্ঘ করতে এই আম রাখবে বড় ভূমিকা। নাবি জাতের গৌড়মতি যেমন একটি দামি আম হয়ে উঠেছে, পেয়েছে দ্রুত জনপ্রিয়তা, তেমনি সম্ভাবনা আছে এ আমেরও। অসময়ের আম তাই পাবে চড়া দামও। লাভবান হবেন চাষি।
বিপ্লবী ইলা মিত্রের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত উঁচু–নিচু ঢেউখেলানো বরেন্দ্রভূমির নাচোলের নেজামপুর ইউনিয়নের কেন্দুয়া গ্রাম। সেখানকার আমচাষি রফিকুল ইসলামের একটি বড় বাগানের হাজার হাজার গাছের মধ্যে কেবল ছোট ছোট ৫০০ গাছে থোকায় ঝুলছে সেই আম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারদিক যখন প্রায় আমশূন্য, তখন কেবল এই বাগানে আমের এমন চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখে আমপ্রেমীরা আপ্লুত না হয়েই পারেন না। বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই বাগানে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছেন পর্যবেক্ষণে যাওয়া কৃষিবিদ, আমবিজ্ঞানীরাও। এ সময় তাঁদের সঙ্গে কথা হলো এই প্রতিবেদকের।
বেসরকারি কলেজে প্রভাষকের চাকরি ছেড়ে ২০০৯ সাল থেকে ফল চাষে যুক্ত হন রফিকুল। জানালেন, ১০ থেকে ১১ বছর ধরে আমটিকে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। তাঁর আম্রপালি বাগানের একটি গাছে আলাদা এমন বৈশিষ্ট্যের আম দেখে শুরু হয় পর্যবেক্ষণ। ওই গাছের ডগা কেটে প্রথমে ১৮টি চারাগাছ তৈরি করে রোপণ করেন। ওই ১৮ গাছের আম বেশ কয়েক বছর পর্যবেক্ষণের পর তিনি তিন বছর আগে ১৮ গাছের ডগা (সায়ন) নিয়ে ৫০০ ছোট গাছে প্রতিস্থাপন করেন টপওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে। দুই বছর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ফলন দিচ্ছে।
সেপ্টেম্বরের ৭-৮ তারিখ থেকে পাকা শুরু করে। ভালোভাবে পাকে মধ্য সেপ্টেম্বরে। থাকে অক্টোবর পর্যন্ত। এ আমে রোগবালাই নেই বললেই চলে। কোনো রাসায়নিক সার প্রয়োগ ছাড়াই চাষ করে আসছেন রফিকুল। এ দিক দিয়ে এ আম চাষে খরচ কম। রফিকুল গত বছর বিক্রি করেছেন ১১ হাজার টাকা মণ দরে। এবার বাগানে কমপক্ষে ৫০ মণ আম হবে। গড়ে ১০ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পারবেন।
আমটির জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেন রফিকুল, ‘চোখ বুজে খেলে আমটি রসগোল্লার মতোই মিষ্টি লাগবে। এটা প্রকৃতিরই দান। আমার হাত দিয়ে প্রসারিত হচ্ছে বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।’
নিজের বাগানে রফিকুল ইসলাম | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বৃহস্পতিবার আমবিজ্ঞানী, কৃষিবিদ ও সংবাদকর্মীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বাগানে আম পাড়া শুরু হয়। উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণাকেন্দ্র) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ও হাফসা বিনতে হারুন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পলাশ সরকার, হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক বিমল কুমার প্রামাণিক, অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক বুলবুল আহমেদ, নাচোল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সালেহ আকরাম ও অন্যরা। বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদেরা ইতিবাচক মতামত দিলে চারা তৈরি করে সামনের বছর থেকে চাষি পর্যায়ে ছড়িয়ে দেবেন, জানালেন রফিকুল।
আম গবেষণাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে রফিকুল ইসলামের আমবাগানের এ আম নিয়ে গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। তিনি বললেন, আমটির ভালো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রোগবালাই নেই বললেই চলে। সংরক্ষণক্ষমতা বেশি। অন্যান্য আম পাড়ার পরে যেখানে ছয় দিন থাকে, সেখানে এই আম থাকে ৮-১০ দিন। বোঁটা শক্ত। খোসা পাতলা। ভক্ষণযোগ্য অংশ ৭৫ ভাগ। মিষ্টতা ২৫ ভাগ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএআরআই) পক্ষ থেকে আমটি অবমুক্ত করার জন্য আম গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রস্তাব পাঠানোর কাজ চলছে।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আমটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। কেননা, নাবি জাতের এমন আম এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। জেলা কৃষি কর্মকর্তা পলাশ সরকার বললেন, ‘রফিকুল ইসলাম বেশ কয়েক বছর ধরে অনেক মায়া–মমতা নিয়ে আমটির ওপর কাজ করছেন।
তাই আমটির নাম রাখা হয়েছে “মায়াভোগ”। তিনি আমটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন ইলা মিত্রের নাম অনুসারে। কিন্তু ইতিমধ্যে ইলামতি নামে একটি থাকায় এ নাম রাখা হয়েছে। আমটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেব আমরা।’
রফিকুলের বাগান থেকে সায়ন নিয়ে হর্টিকালচার সেন্টার মাতৃবাগান গড়ে তুলবে, জানালেন হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক বিমল কুমার প্রামাণিক। তাঁর কথা, দক্ষ আমচাষি রফিকুল ইসলাম প্রাকৃতিকভাবে সংকরায়িত হওয়া আমটি খুঁজে পেয়েছেন। আকারও সুন্দর। আমটি অধিক জনপ্রিয়তা পাবে বলে তাঁর বিশ্বাস।