মুক্তি ভবনে সিপিবির সংবাদ সম্মেলেনে বক্তারা ছবি: সিপিবির সৌজন্যে

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের কমিউনিস্টি পার্টি (সিপিবি) বলেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। দিন দিন অসহায় মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সরকার দাম বেঁধে দিয়েও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। এই অবস্থায় সারা দেশে রেশনব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিবি এই প্রস্তাব দেয়। রাজধানীর পল্টনের মুক্তি ভবনে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।

সেখানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ।

এম এম আকাশ বলেন, বাজারে গেলে মানুষ এখন আর হাসিমুখে ঘরে ফিরতে পারেন না। প্রতিমুহূর্তে তিনি টের পাচ্ছেন যে তাঁর টাকার দাম কমে গেছে। যে হারে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে আয় বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বাজেট থেকে প্রথমে শখের পণ্য, পরে প্রয়োজনীয় পণ্য ছেঁটে ফেলে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং সানেমের জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে করোনাকালে দারিদ্র্যসীমার নিচে যাঁরা নেমে গিয়েছিলেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত সবাই দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসতে পারেননি। আমরা তাই আবার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ দারিদ্র্যের হারের মধ্যেই আছি। সরকারের কমিয়ে দেওয়া ২০ শতাংশকেই যদি হিসাবে ধরি, তাহলে এখন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি লোক প্রয়োজনীয় ক্যালরি খাবার পাচ্ছেন না। তাঁদের কথা সরকার, শাসকগোষ্ঠী ও মুনাফালোভীরা ভাবছে না।

অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘আমাদের দেশের ধনীরা বিদেশে ভোগ-বিলাস এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছেন। কেউ কেউ বিদেশে বিনিয়োগ করে ডলার উপার্জনও করছেন, কিন্তু এগুলো কিছুই দেশে ডলারের রিজার্ভ বাড়াচ্ছে না। সরকার ১ টাকার মেগা প্রজেক্টে ৩ টাকা ব্যয় করছে। সে জন্য চীন, জাপান, ভারত, আইএমএফ থেকে প্রচুর ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে।’

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সরকার উদারভাবে জনগণের টাকা থেকে ঋণ নিয়েছে। ব্যক্তি খাতকেও বৃহৎ ঋণ দিয়েছে। সুদের হার দীর্ঘদিন নয়-ছয়-এ সীমাবদ্ধ রেখেছে। ৯ শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ তারা শোধ করতে পারছে না, অনেকে শোধ করছেন না। ফলে খেলাপি ঋণ জমা হচ্ছে। নতুন উৎপাদনশীল ছোট পুঁজিপতিরা ঋণবঞ্চিত হচ্ছেন।

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি নিয়ে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, একসময় করোনাকালে সেখানে পর্যটন থেকে ডলার আয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রেমিট্যান্সও কমে গিয়েছিল। বিদেশি ঋণ শোধ করতে গিয়ে প্রচুর ডলার বেরিয়ে গিয়েছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পেট্রলের দাম যখন হু হু করে বেড়ে গেল, তখন শ্রীলঙ্কা পুরো রিজার্ভ খরচ করেও সব কূল রক্ষা করতে পারেনি।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ‘শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং তা থেকে আমাদেরও কিছু শেখার আছে কি না, তা ভাবার সময় হয়েছে।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের জরুরি করণীয় সম্পর্কে এম এম আকাশ বলেন, ‘আমাদের যে করেই হোক, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হবে ও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও তার দক্ষ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। এই মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমালেও প্রয়োজনীয় আমদানি আমরা কমাতে পারব না। এবার আমরা ব্রিকসের ব্যাংকে যোগদান করেছি। এটা কিছুটা নতুন ঋণের নতুন উৎস খুলে দিতে পারে।

পক্ষান্তরে যদি আমরা ভুল বাজার নীতি ও কুশাসন, দুঃশাসন অব্যাহত রাখি, শ্রীলঙ্কার মতো ঋণের ফাঁদে পড়ে যাই, তাহলে আমাদের মতো বৃহৎ অর্থনীতির জন্য সেখান থেকে আর বের হয়ে আসা খুবই কঠিন হবে। তাই আজ আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের ও শক্তিশালী রিজার্ভ গঠনের পরিকল্পনা তৈরি করে এগোনো দরকার।’

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরা হয় আজকের সংবাদ সম্মেলনে। এর মধ্যে আছে নিম্নœআয়ের মানুষের জন্য, বিশেষত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের জন্য স্থায়ী রেশনব্যবস্থা চালু করা। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে ছবিসহ রেশন কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এই দরিদ্র মানুষদের জন্য রেশনে কন্ট্রোল দামে চাল, গম, তেল, ডাল, চিনি এবং প্রয়োজনমতো অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রদান করা।

পর্যায়ক্রমে পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো। অন্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আছে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করা, ‘উৎপাদক সমবায় সমিতি’ গড়ে তোলা, কৃষকদের কৃষি উপকরণ ন্যায্যমূল্যে দেওয়া, পণ্য পরিবহনে দুর্নীতি বন্ধ করা, টিসিবিকে শক্তিশালী করা, খাদ্যদ্রব্যসহ অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাফার স্টক গড়ে তোলা, ‘ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণ আইন’ করা।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। এ সময় সিপিবির সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহীন রহমান, সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রেজা, কোষাধ্যক্ষ ফজলুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।