মহিউদ্দিন, ঢাকা: বিভিন্ন দেশে থাকা পুরোনো কর্মীদের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন লাখো কর্মী। গত ১ বছর ৯ মাসে গড়ে প্রতি মাসে লাখের বেশি কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে। অথচ এত কর্মীর তুলনায় প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) তেমন বাড়ছে না। আগের বছরের তুলনায় গত বছর দ্বিগুণ কর্মী গেলেও প্রবাসী আয় কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ।

প্রবাসী খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসী আয় কমার কোনো কারণ নেই। দেশে প্রবাসীদের টাকা আগের চেয়ে বেশি হারেই আসছে। কিন্তু বৈধ পথে না আসায় তা কোনো হিসাবে যুক্ত হচ্ছে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মজুত বাড়ানোর সবচেয়ে বড় দুই ভরসা হচ্ছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। প্রবাসী আয় না বাড়লে মজুত বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অথচ প্রবাসী আয় বাড়াতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম সাত মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৩০৯ কোটি ডলার। এটি গত বছরের প্রথম সাত মাসের চেয়ে কিছুটা বেশি। গত বছর একই সময়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ১ হাজার ২৮৯ কোটি ডলার। আর গত বছরের শেষ পাঁচ মাসে এসেছিল ৮৪০ কোটি ডলার। এ হিসাবে এ বছর প্রবাসী আয় আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বাড়তে পারে। তবে তা খুব বেশি হবে না। যদিও গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় এবার জুলাইয়ে প্রবাসী আয় কমেছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এ ধারায় চলতে থাকলে আগের বছরের চেয়ে কমবে প্রবাসী আয়।

করোনা মহামারি শুরুর পর বড় ধাক্কা খেয়েছিল বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, আগের বছরে সাত লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেলেও ২০২০ সালে এটি দুই লাখে নেমে আসে। এরপর ২০২১ সালে এটি বেড়ে ৬ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

এরপর গত বছর বিভিন্ন দেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি কর্মী। এটি দেশের ইতিহাসে এক বছরে বিদেশে যাওয়ার রেকর্ড। এর আগে ২০১৭ সালে ১০ লাখ পার হয়েছিল। এ বছরও এ ধারা অব্যাহত আছে। বছরের প্রথম সাত মাসেই বিদেশে গেছেন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ কর্মী। অথচ প্রবাসী আয়ে গতি কম।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরি করা, বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো, যত বেশি পারা যায় দক্ষ কর্মী পাঠানো, কর্মী দেশ ছাড়ার আগে তিন দিনের প্রশিক্ষণে তাঁদের সব বিষয়ে অবহিত করার কাজটি করছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে রেকর্ড পরিমাণ কর্মী বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এমনকি বৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর জন্য কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়।

বড় বাধা পাচার ও হুন্ডি–বাণিজ্য 

বিভিন্ন পথে বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়া, ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের মান পার্থক্য বেশি হওয়ায় কমেছে প্রবাসী আয়। রেকর্ড হারে কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রবাসী আয় কমার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা।

তাঁরা বলছেন, যাঁরা গত বছর টাকা পাঠিয়েছেন, তাঁরা বিদেশেই আছেন। এর সঙ্গে লাখো কর্মী নতুন যোগ দিচ্ছেন। করোনার পর চাকরির বাজারও স্বাভাবিক হয়েছে। তাই আগের মতো বকেয়া বেতনের ঘটনা নেই। এতে তো দেশে টাকা পাঠানোর পরিমাণ বাড়ার কথা; কিন্তু বাড়ছে না। ডলারের টালমাটাল পরিস্থিতি সব বদলে দিচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে ডলারের দাম খোলাবাজারে বেশি পাওয়া যায়।

বিদেশে মাত্র ২ শতাংশ কর্মী গেছেন সরকারি ব্যবস্থাপনায়। আর বেসরকারি খাতে প্রতিটি ভিসা নিয়ে একটি বাণিজ্য হয়। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে একটি ভিসা নিতে অন্তত ৫০০ মার্কিন ডলার লেনদেন হয়। বৈধ পথে বিদেশে টাকা পাঠানোর সুযোগ না থাকায় এ টাকা যায় হুন্ডির (অবৈধ লেনদেন) মাধ্যমে। যত বেশি কর্মী যাবেন, তত বেশি টাকা পরিশোধ করতে হবে। তাই কর্মী যাওয়া বেড়ে যাওয়ায় দেশে ডলার আসা কমে গেছে।

এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, পুরোনোদের সঙ্গে গত দুই বছরে ২০ লাখের বেশি নতুন কর্মী যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। তাঁরা তো টাকা পাঠাচ্ছেন। তাহলে প্রবাসী আয় তো কমার কথা নয়। অনানুষ্ঠানিক পথে ৩০০ ডলার পাঠালে একজন কর্মী আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি পান। এটা বন্ধ করতে হলে সরকারি প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে ব্যাংকগুলোর প্যাকেজ চালু করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, প্রণোদনা বাড়ানো হলে বা ব্যাংকে ডলারের বিনিময় হার বাড়ানো হলে খোলাবাজারেও তা বাড়বে। এভাবে হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কখনো পারা যাবে না। মানুষকে বোঝাতে হবে, তাঁরা অবৈধ পথে লেনদেন করে অন্যায় করছেন।

তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এটা জনগণ যত দিন না বুঝবেন, তত দিন ঠিক হবে না। এ ছাড়া হুন্ডি বন্ধে কাজ চলছে। হুন্ডির অভিযোগে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হচ্ছে।

খোলাবাজারের সঙ্গে পারছে না ব্যাংক
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারি শুরুর পর প্রবাসীরা বাধ্য হয়ে ব্যাংকে টাকা পাঠানো শুরু করেন। যার ফলে রেকর্ড প্রবাসী আয় আসে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে ডলারের সীমান্ত অতিক্রম কমতে থাকে। তাই দেশের রিজার্ভও বাড়ছে না। ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো প্রবাসী আয়ে সরকার আগে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিত। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে প্রণোদনার হার বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। যদিও এটি ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব ছিল প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা পাঠানোর খরচ নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এতে দেখা যায়, দেশে ১০০ টাকা পাঠাতে গড়ে ৩ টাকার বেশি খরচ হয় একজন প্রবাসী কর্মীর। সবচেয়ে বেশি প্রবাসী থাকেন সৌদি আরবে। দেশটি থেকে বাংলাদেশে ১০০ টাকা পাঠাতে খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৩ টাকা।

একজন প্রবাসী কর্মী ব্যাংকে ১০০ টাকা পাঠালে প্রণোদনাসহ ১০২ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন। কিন্তু খরচ হচ্ছে গড়ে ৩ টাকা। এতে দেশে তাঁর পাঠানো ১০০ টাকা থেকে ৫০ পয়সা কমে যাবে। এ ছাড়া সবচেয়ে বেশি পার্থক্য এখন ডলারের দামে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি। প্রণোদনার চেয়েও কর্মী বেশি লাভ পাচ্ছেন ব্যাংকের বাইরে টাকা পাঠিয়ে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো কর্মীর বেশির ভাগের আয় মাসে ২০০ থেকে ৩০০ ডলার। একজন কর্মী এক ডলারের বিনিময়ে বাজারে ৮ টাকা বেশি পেলে তিনি কোনোভাবেই ব্যাংকে তা পাঠাবেন না। তাই ব্যাংক থেকে ডলারের সঠিক দাম দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল বলেছেন, ‘ডলারের দাম ১০৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৫ টাকার ওপরে তুলতে হবে। এই সময়ে বাজার থেকে ডলার কিনতে গেলে ১১৬ টাকা লাগছে। হুন্ডিওয়ালা যদি এই দাম দেয় আর কারও যদি হুন্ডিওয়ালার সঙ্গে পরিচয় থাকে, তাহলে কোন বোকা অফিশিয়াল চ্যানেলে টাকা পাঠাবে?’

সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ অর্থবছরে সরকার ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স ঢুকেছে আরও কমপক্ষে ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা বিশেষজ্ঞরা অনুমান করে থাকেন। ডলারের সঠিক দাম না দিলে এই অবৈধ চ্যানেল কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না।’ 

ব্যাংকে আনতে হবে প্রবাসীদের
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরু বলছে, গত বছর অভিবাসন বাড়লেও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। কর্মসংস্থান বাড়া-কমার প্রভাব পড়তে দুই বছর সময় লাগে। সে সময়ও ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। এখন মূলত ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্যের কারণেই প্রবাসী আয় বাড়ছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রপ্তানি শিল্প, কৃষিসহ নানা খাতে ব্যাংকের বিভিন্ন প্যাকেজ আছে। অথচ প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করা নিয়ে কোনো প্রচার নেই। ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহক হলে সহজ শর্তে ঋণসুবিধাসহ নানা সহায়তার প্যাকেজ দিতে পারে ব্যাংক। অবৈধ পথে পাঠিয়ে টাকা হারানোর ঝুঁকিটাও বোঝাতে হবে প্রবাসীদের।

ব্যাংকে ডলারের বিনিময় হার আরও বাড়িয়ে খোলাবাজারের কাছাকাছি করতে হবে। সরকারি প্রণোদনা অন্তত ৫ শতাংশ করতে হবে। হুন্ডির চেয়ে ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে যদি একই রকম সুবিধা পাওয়া যায়, তাহলে প্রবাসীরা উদ্বুদ্ধ হবেন। আর এটি করা হলে ২ হাজার ২০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা করা সম্ভব প্রবাসী আয়।

রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, দেশে প্রবাসীদের টাকা আসছে অনানুষ্ঠানিক পথে। তাঁদের টাকা ব্যাংকে নিতে হলে অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের সমান সুবিধা দিতে হবে। না হলে কখনোই একজন কর্মী জেনে–বুঝে লোকসান করবেন না। প্রবাসী আয় নিয়ে সরকারের চাহিদা থাকলে বাজার ও ব্যাংকের দূরত্ব ঘোচাতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকের ওপর আস্থা ফেরাতে হবে। এটা এখন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।