ডেঙ্গুর সব লক্ষণ গুরুত্ব পাচ্ছে না স্বাস্থ্যের তথ্যে

ডেঙ্গু | প্রতীকী ছবি

শিশির মোড়ল, ঢাকা: এ বছর ডেঙ্গুর নতুন কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মৃত্যুর হারও বেশি। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে ডেঙ্গুর একটি লক্ষণই গুরুত্ব পাচ্ছে। সেটি ডেঙ্গু জ্বর। রোগী মারাও যাচ্ছেন ডেঙ্গু জ্বরে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু চিকিৎসা ও ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনাবিষয়ক নির্দেশিকায় ডেঙ্গুর চারটি লক্ষণের কথা উল্লেখ আছে—ডেঙ্গু জ্বর, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। 

জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ নিয়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ঢালাওভাবে—এমন তথ্য দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই এমনভাবে তথ্য দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে আরও সচেতন ও মনোযোগী হওয়া।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আগে দেখেছি ডেঙ্গুতে শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে, শরীরে তীব্র ব্যথা হয়। চার–পাঁচ দিন পর জ্বর ভালো হয়ে যায়। তারপর থেকে রক্তে অণুচক্রিকা কমতে থাকে। তখনই বিপদের ঝুঁকি দেখা দিতে থাকে। এটাই আমাদের জানা ছিল।’

কিন্তু এ বছর ডেঙ্গুর লক্ষণে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়া অনেক রোগী দেখছি, যাঁদের জ্বর বেশি দেখা যাচ্ছে না। শরীরে তীব্র ব্যথার কথা অনেকেই বলছেন না। বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অল্প সময়ের মধ্যে রোগী শকে চলে যাচ্ছেন, অর্থাৎ রক্তে অণুচক্রিকা কমে আসছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, রোগী অচেতন হয়ে পড়ছেন। ডেঙ্গুর এই লক্ষণ আমরা আগে দেখিনি।’

এই অভিজ্ঞতার কথা একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সভা–সেমিনার বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বলছেন। গত রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত ডেঙ্গুবিষয়ক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও বাংলাদেশে মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেছেন, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ‘শক সিনড্রোম’ (অচেতন হওয়ার লক্ষণ) বেশি দেখা যাচ্ছে। 

অমনোযোগ ও বিভ্রান্তির সুযোগ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে প্রতিদিন ডেঙ্গুর তথ্য গণমাধ্যমসহ সরকারে বিভিন্ন দপ্তরে সরবরাহ করে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা কন্ট্রোল রুমের পাঠানো তথ্যই ব্যবহার করে।

একটি নির্দিষ্ট ছকে প্রতিদিন ডেঙ্গুর তথ্য পাঠানো হচ্ছে। তাতে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার নতুন তথ্যের পাশাপাশি সারা বছরের তথ্য আছে। ওই ছকে ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ও ডেঙ্গু শক—এ তিনটি পৃথক ঘর আছে। কিন্তু তথ্য দেওয়া হয় শুধু ডেঙ্গু ফিভার বা ডেঙ্গু জ্বরের। বাকি দুটি ঘরে দিনের পর দিন ‘০’ (শূন্য) লেখা হচ্ছে।  

কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১ লাখ ১৬ হাজার ৮৪২ জন। মারা গেছেন মোট ৫৫৬ জন। কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, তাঁরা সবাই আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গু জ্বরে। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা ডেঙ্গু জ্বরেই মারা গেছেন। কেউ ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ও ডেঙ্গু শক ফিভারে আক্রান্ত হননি বা মারাও যাননি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এই তথ্য অসম্পূর্ণ এবং বিভ্রান্তকর।’

গতকাল সোমবার শহীদ সোহরাওর্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা ও চিকিৎসক বলেছেন, অনেক রোগী আসছেন ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নিয়ে। অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালেরও একই অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা। 

সমস্যা ও সমাধান কী
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ছক থেকে ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ও ডেঙ্গু শক ফিভার—এ তিনটি লক্ষণের উল্লেখ না করে শুধু ‘ডেঙ্গু’ লিখলে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ থাকে না। তাতে বোঝা যাবে ডেঙ্গুতে কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন বা কত মানুষ মারা যাচ্ছেন।

তবে তাতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। পরিস্থিতি বুঝতে ডেঙ্গু ফিভার, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক ফিভার ও এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু ফিভার—প্রতিটি লক্ষণ সম্পর্কে তথ্য দরকার। এসব বিশেষ করে দরকার চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের। 

কন্ট্রোল রুম ও বিভিন্ন হাসপাতালে কথা বলে জানা গেছে, জরুরি বিভাগে রোগী আসার পর ডেঙ্গু রোগী হিসেবে নিবন্ধন করা হয়। তখন ডেঙ্গুর লক্ষণ বুঝে শ্রেণি বিভাগ সম্ভব হয় না। গড়পড়তা ডেঙ্গু জ্বর লেখা হয়। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সেই তথ্যই কন্ট্রোল রুমে পাঠানো হয়।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, করোনার মহামারির সময় সাধারণ রোগী ও করোনা রোগী একসঙ্গে যেন মিলেমিশ না যান, সে জন্য হাসপাতালে ট্রায়েজ ব্যবস্থা (রোগী বাছাই করে পৃথক করা) চালুর চেষ্টা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা ডেঙ্গুর এই জরুরি পরিস্থিতিতে কাজে লাগানো দরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ বে–নজির আহমেদ বলেন, হাসপাতালে রোগী ভর্তির সময় লক্ষণ বুঝে ডেঙ্গু জ্বর, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমের রোগী আলাদা করতে হবে। এতে হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনা ভালো হবে। রোগী অল্প সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাবেন। অন্যদিকে অসম্পূর্ণ তথ্যের যে অভিযোগ উঠেছে তা দূর হবে।