ড্রোন হামলায় জ্বলছে দানিউব নদীর তীরে অবস্থিত ইউক্রেনের বন্দরের একটি ভবন | ছবি: এএফপি

দ্য গার্ডিয়ান: প্রচলিত সব ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করে ইউক্রেন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। এরপর শুরু করে জ্বালানিযুদ্ধ। তারা ইউক্রেনের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করে ও পুরো জাতিকে বরফে জমিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতেও তারা সফল হয়নি। এখন তারা নেমেছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো যুদ্ধকৌশল ‘খাদ্যযুদ্ধে’।

গত জুনে কাখোভকা বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় কৃষিজমি মরুতে রূপান্তরের চেষ্টা করছে রাশিয়া। অন্যদিকে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানিতে বাধা না দিতে ‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ (বিএসজিআই)’ চুক্তিতে সই করেছিল রাশিয়া। কিন্তু গত মাসে তারা সেই চুক্তি থেকে সরে আসে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার নৌবাহিনী ইউক্রেনের বন্দরগুলোকে কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলে। এ ছাড়া তারা দানিউব নদীর রেনি ও ইজমাইল বন্দরে সরাসরি হামলা চালিয়েছে। এতে ইতিমধ্যে রপ্তানির জন্য মজুত রাখা ২ লাখ ২০ হাজার টন খাদ্যশস্য ধ্বংস হয়ে গেছে।

রাশিয়ার বিএসজিআই থেকে সরে আসা ও নৌ অবরোধের কারণে জুলাইয়ের শেষের দিকে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দামের সূচক ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পথে বছরে ৩ কোটি ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য রপ্তানি হয়ে থাকে, যা ইউক্রেনের মোট রপ্তানিযোগ্য খাদ্যশস্যের অর্ধেকের বেশি। অনেক ব্যবসায়ী আশঙ্কা করছেন, এমন পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ খাদ্যশস্যের মূল্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

আদতে এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খাদ্যকে একটি যুদ্ধাস্ত্রে রূপান্তর করা হচ্ছে। আর রাশিয়া ফিরিয়ে আনছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো যুদ্ধনীতি। প্রাচীন সৈন্যরা তাদের প্রতিপক্ষকে বশে আনার জন্য তাদের খাদ্যশস্যে অবরোধ দিত, যাতে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দেয়।

সংকট ছড়াল বিশ্বব্যাপী
রাশিয়ার এই খাদ্য রণনীতির কারণে ইউক্রেনের অর্থনীতি আবার ধ্বংসের মুখোমুখি। একই সঙ্গে এ সুযোগে রাশিয়া তাদের পণ্য উচ্চমূল্যে রপ্তানির সুযোগ পাবে। আর এসব কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে শত শত মাইল দূরে থাকা বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এমনকি খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য ও ত্রাণ সরবরাহের স্বল্পতার কারণে সেসব দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষও নেমে আসতে পারে।
 
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) দরিদ্র দেশগুলোতে ত্রাণ দিতে বিশ্ববাজার থেকে যে পরিমাণ গম কিনে থাকে, তার অর্ধেকেরই জোগান আসে ইউক্রেন থেকে। এসব গমের বেশির ভাগই যায় আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেনে। ভালো মানের এসব গম সহজেই ইউক্রেনের ওদেসা থেকে কৃষ্ণসাগর দিয়ে বসফরাস প্রণালি হয়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাত। এরপর সুয়েজ খাল হয়ে এসব খাদ্যশস্য চলে যেত ইয়েমেন ও আফ্রিকার দরিদ্র্য দেশগুলোয়। অথচ ডব্লিউএফপিকে এসব গম এখন কিনতে হচ্ছে উচ্চমূল্যে। আবার পরিবহন করতে হচ্ছে দীর্ঘ পথ ঘুরে। এতে পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। তারা এখন বিকল্প পথে বাল্টিক ও ইউরোপীয় বন্দরগুলো থেকে আফ্রিকা অথবা এশিয়ায় খাদ্য পরিবহন করছে।

কৃষ্ণসাগরের পথ বন্ধ থাকায় বিকল্প সড়কপথে রপ্তানি করা হচ্ছে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য। রোমানিয়ার কনস্তানতা বন্দরে গাড়ির দীর্ঘ সারি | ছবি: এএফপি

ডব্লিউএফপির মুখপাত্র স্টিভ ট্রাভেলা বলেন, বিএসজিআই ছাড়া তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয়সংখ্যক মানুষকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া সত্যিই কষ্টের হয়ে যাবে। এ ছাড়া এমনিতেই ডব্লিউএফপি গত ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তহবিলসংকটে রয়েছে। এর ফলে তাদের বিকল্প বেছে নিতে হচ্ছে। হয়তো ত্রাণের পরিমাণ কমাতে হচ্ছে, না হলে সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমাতে হচ্ছে।

ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন বলেন, এই যুদ্ধের (রাশিয়া-ইউক্রেন) কারণে খাদ্যসংকটে থাকা দেশগুলো টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। তারা ‘কোলারোল ড্যামেজ’ (যুদ্ধের অংশ না হয়েও প্রাণহানিসহ নানা ক্ষতির সম্মুখীন)-এর শিকার হচ্ছে।

বিকল্প পথ ব্যবহারে জটিলতা
৫০টির বেশি দেশ ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করছে। তারা সেখানে দ্রুত অস্ত্র সরবরাহ করতে ‘রামস্টেইনের’ (জার্মানিতে থাকা মার্কিন বিমানঘাঁটি, যা ব্যবহার করে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়) মতো ফোরাম গঠন করেছে। কিন্তু খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে এমন সমন্বিত কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছে টুকরো টুকরো বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর।

ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য ‘সংহতি পথ’-এর (সলিডারিটি লেনস) ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ ঘোষণার আওতায় ইউক্রেন ইউরোপের রেল, সড়ক ও অভ্যন্তরীণ পানিপথ ব্যবহার করে তাদের খাদ্য রপ্তানি করতে পারবে। ক্রোয়েশিয়া তাদের রিয়েকা বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। একইভাবে ইউক্রেনকে বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো (লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া)।

যাহোক, পশ্চিমা ভূমি ব্যবহার করা ইউক্রেনের জন্য জটিল ও ব্যয়বহুল। ইউক্রেন উত্তরাধিকারসূত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যেসব রেলপথ পেয়েছে, তার অধিকাংশই ইউরোপের যেকোনো রেলপথের তুলনায় বিস্তৃত। ফলে ইউক্রেনকে খাদ্য রপ্তানি করতে হলে সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথই বেছে নিতে হবে।

এদিকে নিজেদের কৃষকদের চাপের মুখে ইউরোপীয় পাঁচ প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেন থেকে শস্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। তবে এসব দেশের ওপর দিয়ে ইউক্রেনের পণ্য রপ্তানির অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন থেকে রপ্তানির জন্য পোল্যান্ড সীমান্তে আনা পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার কারণে লরিগুলোকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য ‘গ্রিন করিডোরস’ চালুর আলোচনা চলছে। এটি হলে, ইউক্রেন তাদের খাদ্যপণ্য ও প্রাণী শুল্ক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই গন্তব্যের বন্দরে পৌঁছাতে পারবে। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ ও পক্ষগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। 

রোমানিয়ার কনস্তানতা বন্দর জাহাজে বোঝাই করা হচ্ছে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য | ছবি: এএফপি 
 
কৃষ্ণসাগরই ভরসা
ইউক্রেনের ওদেসাভিত্তিক খাদ্য সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠান ট্রান্সফেরির বাণিজ্যিক পরিচালক আলেক্সান্দার কোরোলিভ বলেন, জার্মানিতে বিকল্প পথে শস্য রপ্তানি করতে গিয়ে প্রতি টনে তাদের ১৫০ ইউরো তথা ১৬৪ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এমন অবস্থায় এ ব্যবসা তাদের জন্য সত্যিকার অর্থে অলাভজনক।

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি আন্তর্জাতিক কোনো তহবিল থেকে বহন করার আবেদন জানানো হয়েছে। তবে কোনো পক্ষ থেকে এমন অর্থ আসবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।

কোরোলিভ মনে করেন, ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে কৃষ্ণসাগরকেন্দ্রিক চুক্তি বিএসজিআইয়ের বিকল্প ভালো কোনো বিকল্প নেই। বিএসজিআইয়ের অধীনে সহজেই দানিউব নদীতে অবস্থিত ইউক্রেনের বন্দর ইজমাইল ও রেনি এবং রোমানিয়ার বন্দর গ্যালাসি ও ব্রাইলা থেকে জাহাজে মালামাল তোলা যায়। এসব বন্দর থেকে সহজেই দানিউবের তিনটি জলপথ অথবা দানিউব-কৃষ্ণসাগরের দুটি শাখা জলপথ হয়ে দক্ষিণে রোমানিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দর কনস্তানতায় পৌঁছানো সম্ভব। পরে সেখান থেকে ৫০ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বড় বড় জাহাজে করে এসব খাদ্যশস্য কৃষ্ণসাগর হয়ে বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা যায়।
কৃষ্ণসাগরের পথ ব্যবহার করলে এসব পণ্যবাহী রপ্তানির জাহাজ নিরাপদে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও তুরস্কের উপকূল হয়ে নিরাপদে বসফরাস প্রণালি (এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যবর্তী অঞ্চলের সরু জলপথ, যা কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে মারমারা উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। গেল বছরে এই জলপথে প্রায় দুই কোটি টন খাদ্যশস্য রপ্তানি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আরও কিছু বিনিয়োগ করা গেলে, এই পথে বছরে সাড়ে তিন কোটি টন পর্যন্ত খাদ্য রপ্তানি করা যেত, যা বিএসজিআইয়ের অধীনে রপ্তানি হওয়া মোট পণ্যের চেয়েও বেশি।

আশার কথা, কৃষ্ণসাগর ব্যবহার করে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে ইউক্রেনকে অনুমতি দিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এ কারণে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু মানুষ মনে করছেন, বিএসজিআই চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।

সংক্ষেপিত অনুবাদ: মো. ছানাউল্লাহ