নতুন মানচিত্র প্রকাশে চীনের বার্তা বুঝতে চাইছে দিল্লি

অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে বিতর্ক বহুদিনের | ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রতিনিধি নয়াদিল্লি: নতুন মানচিত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে চীন ঠিক কী বোঝাতে চাইছে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মুহূর্তে তা বুঝতে চাইছে। চীনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য না করলেও ভারতের নীতিনির্ধারকদের কারও কারও ধারণা, পূর্ব লাদাখে তাদের অবস্থানের বিশেষ রদবদল ঘটাতে তারা যে অনাগ্রহী, এই মানচিত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে বেইজিং সেটাই বুঝিয়ে দিতে চাইছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও একাংশ মনে করছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) বিশেষ করে ডেপসাং ও ডেমচকে চীনা ফৌজ যে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, সেখান থেকে সরে আসতে তারা একেবারেই চায় না। দুই বাহিনীর মধ্যে ১৯তম আলোচনাও তাই অসফল। মানচিত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেই অনড় অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চীন চাইছে ভারতকে অন্য ধরনের চাপের মধ্যে রাখতে।

পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তানের মধ্য দিয়ে চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ভারত বারবার তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর প্রকল্পে হাত দেওয়ার পরেই চীনকে চাপে রাখতে ভারতও কারাকোরাম গিরিপথ লাগোয়া লাদাখে দৌলতবেগ ওলডি সড়ক নির্মাণে উদ্যোগী হয়। এই অঞ্চলে ভারতের সামরিক শক্তি বাড়ানো আকসাই চীনের নিরাপত্তা নিয়ে চীনকে সতর্ক করেছে। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ ও রাজ্য দ্বিখণ্ডিত করার সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় বলেছিলেন, ‘যখন আমি জম্মু-কাশ্মীরের কথা বলি, তখন তার মধ্যে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চীনকে অন্তর্ভুক্ত করি। এদের জন্য আমরা প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত।’ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাংশের মতে, আকসাই চীনকে বেইজিং বরাবর তাদের সিনকিয়াং প্রদেশের অংশ দাবি করে এসেছে। সেই দাবি জোরালো করতে এবার তারা ওই অঞ্চলকে তাদের ম্যাপে ঢুকিয়ে দিল। এবং তার মধ্য দিয়ে বোঝাতে চাইল ভারতের দাবিকে তারা গুরুত্বই দেয় না। অথচ ভারত তাদের সেই গুরুত্ব অনুধাবন করাতে আগ্রহী। সে কারণে বারবার লাদাখ সীমান্তে স্থিতাবস্থা রক্ষায় এত জোর দিয়ে চলেছে।

চীন ঠিক কী করতে চায়, তা বোঝার চেষ্টার মধ্যেই প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস মানচিত্র প্রকাশ নিয়ে মোদি-সরকারকে নতুন চাপের মুখে ফেলেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আজ বুধবার এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিবৃতিই শুধু দাবি করেননি, তাঁকে মিথ্যাবাদীও বলেছেন। কর্ণাটক যাওয়ার আগে দিল্লি বিমানবন্দরে সংবাদমাধ্যমকে রাহুল বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, লাদাখে চীন ভারতের এক ইঞ্চি জমিও দখল করেনি বলে প্রধানমন্ত্রী যা জানিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি মিথ্যা। আমি সদ্য লাদাখ ঘুরে এসেছি। গোটা লাদাখ জানে চীন ভারতের জমি দখল করে রেখেছে। এই মানচিত্রও খুবই গুরুতর। প্রধানমন্ত্রীর এ নিয়ে মুখ খোলা উচিত।’

চীন গত সোমবার তাদের দেশের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখের আকসাই চীন তাতে তাদের অংশ দেখানো হয়েছে। তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরও সেই মানচিত্রে চীনের অংশ দেখানো হয়েছে।

মানচিত্র প্রকাশের এই ‘টাইমিং’ চিন্তায় রেখেছে ভারতকে। কারণ, এটা প্রকাশ করা হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় সি চিন পিং ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের চার দিন পর এবং দিল্লিতে জি–২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনের দুই সপ্তাহ আগে। ওই সময় সি চিন পিংয়ের দিল্লি আসার কথা। সাউথ ব্লক বোঝার চেষ্টা করছে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বেইজিং এটা করল। ওই বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আসবেন না। সি চিন পিংও না আসার একটা কারণ তৈরি করছেন কি? তাই মানচিত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে এলএসি বরাবর তাদের দাবি যে অপরিবর্তনীয়, তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন? অরুণাচল প্রদেশকে কেন্দ্র করে নতুন চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন?

উদ্দেশ্য যা–ই হোক, চীনা মানচিত্র প্রকাশ ভারতকে প্রবল অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এবং সেটা করা হলো এমন সময় যখন জি-২০ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ভারতে সাজ সাজ রব উঠে গেছে। নরেন্দ্র মোদিকে ‘বিশ্বগুরু’ করে তুলতে চেষ্টার অন্ত রাখা হচ্ছে না। ভারত একান্তভাবেই চাইছিল জি-২০ সম্মেলনের আগে অন্তত লাদাখের সীমান্ত সমস্যার একটা সুরাহা হয়ে যাক। কিন্তু বেইজিংয়ের এই মনোভাব স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, সম্ভবত তা হওয়ার নয়। সীমান্ত বিবাদ নিয়ে ভারত যা–ই বলুক, যতই বলুক সীমান্ত সমস্যা না মিটলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না, চীন যে তা গ্রাহ্য করছে না, এই পদক্ষেপ তারই প্রমাণ।

চীনের এই সিদ্ধান্ত সরকার, প্রধানমন্ত্রীর বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, সর্বদলীয় বৈঠকে তিনিই বলেছিলেন চীনা ফৌজ কোনো জমি ও ঘাঁটি দখল করে বসে নেই। রাহুল গান্ধী বারবার সেই প্রসঙ্গ তুলে সরকারকে কোণঠাসা করতে চাইছেন। চীনও এলএসিতে ‘স্থিতাবস্থা ফেরাতে’ কোনো গা করছে না। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট ও আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে এই বিষয়টি বিরোধী প্রচারে বড় হয়ে উঠে আসবে। বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রীর সেটা বড় চিন্তা।

চীনা মানচিত্র নিয়ে মঙ্গলবার থেকেই কংগ্রেস আক্রমণাত্মক। কংগ্রেসের লোকসভা সদস্য ও ওয়ার্কিং কমিটির নেতা মণীশ তিওয়ারি গত মঙ্গলবার দাবি জানিয়েছিলেন, চীনের প্রেসিডেন্টকে যেন জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো না হয়। কারণ, তিনি এলে ভারতের আত্মসম্মানে ঘা লাগবে। বুধবার রাহুল নতুন চাপ সৃষ্টি করলেন প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে। কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও বুধবার এই প্রশ্নে সরব হয়েছেন। বিজেপি নেতা সুব্রাক্ষ্মণ্যম স্বামী এই বিতর্কে অংশ নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে লিখেছেন, ভারতমাতার অখণ্ডতা রক্ষা করতে না পারলে বরং সরে যান।  

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত মঙ্গলবার এনডিটিভি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, নতুন নতুন ম্যাপ তৈরি করা এবং তাতে অন্য দেশের এলাকাজুড়ে দেওয়া চীনের পুরোনো অভ্যাস। এ দিয়ে কিছু প্রমাণ হয় না। অবাস্তব দাবি জানিয়ে অন্যের জায়গা দখল করা যায় না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানিয়েছিলেন, ওই ম্যাপ নিয়ে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে। চীনকে বলা হয়েছে, এ ধরনের পদক্ষেপ সীমান্ত সমস্যা জটিল করে তুলবে।

কিন্তু সেটাই যে সব নয়, সে কথা আজ বুধবার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন শশী থারুর। ‘এক্স’ হ্যান্ডেল (সাবেক টুইটার) মারফত তিনি বলেছেন, ‘জয়শঙ্কর ঠিকই বলেছেন। এটা চীনাদের পুরোনো বদভ্যাস। আমাদের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করাও চীনের অভ্যাস। তাই বলে আমরা কি চুপ করে থাকব? আমরা কি আমাদের অসন্তোষ অন্যভাবে প্রকাশ করতে পারি না? আমরা কেন তিব্বত থেকে ভারতে আসা চীনাদের স্টেপলড ভিসা দেওয়া শুরু করছি না? এক চীন নীতিকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করছি না?’

‘স্টেপলড ভিসা’ এক অন্য ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় পাসপোর্টে ছাপ না মেরে অন্য এক কাগজে ভিসা দেওয়া হয়। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দাদের চীন এভাবে ভিসা দিয়ে থাকে। কারণ, তাঁরা তাঁদের ভারতীয় নাগরিক বলে মনে করেন না। কাশ্মীরের কোনো কোনো বাসিন্দার ক্ষেত্রেও চীন এমন ভিসা দিয়েছিল। ভারত অনেক বছর ধরে এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। শশী থারুর এবার সেই ব্যবস্থা চালু করার জন্য ভারত সরকারকে চাপ দিলেন। তিনি না বললেও যা কিনা ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’। যার অর্থ, শঠের সঙ্গে আচরণও শঠের মতো হওয়া দরকার। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ ছাড়া বাড়তি কী করবে ভারত? আগ্রহ তা নিয়েই।