ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মৃত্যু

ডেঙ্গু | প্রতীকী ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডেঙ্গুতে এ বছর যত মৃত্যু হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি ঘটেছে হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। আর ৮০ ভাগের বেশি রোগীর মৃত্যু হয়েছে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে। দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক পর্যবেক্ষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। গত সোমবার সরকারি নানা সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে এ চিত্র তুলে ধরে জাতিসংঘের সংস্থাটি।

চলতি বছরের শুরু থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান ৪৪৪ জন। তাঁদের মৃত্যু নিয়েই ডব্লিউএইচওর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ সময়ে ২৪৭ জন বা ৫৬ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির এক দিনের মধ্যে। আর ৮১ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে।

যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মৃত্যুর আগে হাসপাতালে থাকার গড় সময় ২ দশমিক ৬৬ দিন। এর মধ্যে মৃতদের দুই থেকে তিন দিন হাসপাতালে কাটানোর সময় ২৫ শতাংশ। চার থেকে পাঁচ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৮ শতাংশ মানুষের।

ডব্লিউএইচওর এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ বলেন, মাত্র এক দিনের মধ্যে এত মানুষ মারা যাবে, এটা শুধু দুঃখজনক নয়, একেবারেই অপ্রত্যাশিত। দ্রুত মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন।

বে-নজীর আহমদ বলেন, লক্ষণ খুব প্রকট না হলে অনেক মানুষ হাসপাতালে যেতে চান না। এর কারণ, সেখানে ভোগান্তি ও খরচ। অনেকেরই চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা কম। আবার অনেক ক্ষেত্রে এক বা একাধিক অঙ্গ অকার্যকর হয়ে যাওয়ার পর হাসপাতালমুখী হন রোগী। তখন হাসপাতালে গিয়ে এসব বিষয়ে কতটুকু দৃষ্টি দেওয়া হয়, সেটিই প্রশ্ন; বা দেওয়া হলেও সেটি অনেক দেরি হয়ে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম ভিন্ন একটি কারণের কথা বললেন। তিনি বলেন, অনেকেই সাধারণ জ্বর ভেবে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান। পাস করা চিকিৎসকের কাছে যান না, তাঁদের পরামর্শ নেন না। আমরা বারবার বলে আসছি, এখন জ্বর বা কোনো লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যেতে। কিন্তু শকে চলে যাওয়ার পর অনেকেই আসেন।

১১ বছর থেকে ৪০ বছর বয়সীরা হাসপাতালে টিকছেন কম
ডব্লিউএইচওর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হাসপাতালে গিয়ে সবচেয়ে কম সময়ের ব্যবধানে মৃত্যু হয়েছে ১১ বছর থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষের। তাঁদের চেয়ে ষাটোর্ধ্বদের হাসপাতালে গিয়ে বেশি সময় পর মৃত্যু হয়েছে। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে গিয়ে মারা গেছেন। তারপর আছে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা। এক দিনের একটু বেশি সময় তাঁরা হাসপাতালে টিকেছিলেন। এরপর আছে ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা। হাসপাতালে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ তিন দিনের বেশি সময় পর মৃত্যু হয়েছে ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সী মানুষের। 

অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সীদের মধ্যে হাসপাতালে গিয়ে এত দ্রুত মৃত্যুর কারণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এ নিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা দরকার। সেটা এই মুহূর্তে আমাদের নেই। তবে ধারণা করতে পারি, এই বয়সীদের অনেকে প্রথম থেকে অসুখকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। সাধারণ জ্বর ভেবে হয়তো অবজ্ঞা করেন। পরে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে তাঁরা হাসপাতালে যান।

বেশি বয়সীদের হাসপাতালে বেশি সময় ধরে টিকে থাকার কারণ হিসেবে অধ্যাপক আবদুল্লাহর কথা, বয়স বেশি হওয়ার কারণে পরিবার ঝুঁকি নেয় না। দ্রুত তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে। তাই হয়তো তাঁরা বেশি সময় টিকে থাকেন।

দুই ধরনে আক্রান্ত বেশি
ডেঙ্গুর চারটি ধরন। এর মধ্যে আছে ডেন ১, ২, ৩ ও ৪। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ বছর ডেন–২ ও ৩–এর মাধ্যমে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন রোগীরা। মোট আক্রান্ত রোগীর ১৯ ভাগ দুটি ধরনেই আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকে। এরপর ২০০১ সাল থেকেই চারটি ধরনেরই বিস্তার ঘটে। ২০০০ সালে ডেঙ্গু ব্যাপক হারে প্রাদুর্ভাবের বছরে ডেন–৩–এর প্রভাব ছিল। দেশে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালেও প্রাধান্য ছিল ডেন–৩–এর। তবে গত বছর ডেন–৩–এর পাশাপাশি ৪–এর প্রাধান্যও লক্ষ করা গেছে।

অধ্যাপক বে–নজীর মনে করেন, এবার বেশি মৃত্যুর কারণ একাধিক ধরনের সংক্রমণ। এতে করে রোগী আক্রান্ত হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। রোগী দ্রুত বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। একবার একটি ধরনে আক্রান্ত হয়ে পরেরবার নতুন ধরনে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি জটিল হতে বাধ্য। 

উভয় ব্যবস্থাপনাতেই সমস্যা
ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, মৃত্যুর এ চিত্র ভীতিকর। এত দ্রুত মৃত্যুর ঘটনায় মনে হয়, হাসপাতালের ভেতর ও বাহির উভয় ব্যবস্থাপনাতেই সমস্যা আছে।

রোগী হয়তো খুব জটিল অবস্থায় হাসপাতালে আসছে। সেখানে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধার সমস্যা থাকতে পারে। আবার ডেঙ্গুর লক্ষ্মণ দেখা দিলেও রোগীদের দেরি করার প্রবণতাও আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি এতটা জটিল হয় না।

২৪ ঘণ্টায় আরও ৮ জনের মৃত্যু
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ছয়জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে দুজন মারা গেছেন। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে ৫১৪ জন মারা গেলেন। আর চলতি মাসে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৬৩ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে ২ হাজার ২০১ জন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৯২৬ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ২৭৫ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।

এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৮ হাজার ৬৩০ জন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৫১ হাজার ৯৫৩ ও ঢাকার বাইরে ৫৬ হাজার ৬৭৭ জন।