সাভার প্রতিনিধি: প্রথমবারের মতো নিজস্ব সক্ষমতায় মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম গরু (মুন্সিগঞ্জ ক্যাটেল), দেশীয় প্রজাতির ভেড়া ও হাঁসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স (জিন নকশা উন্মোচন) সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি)। বৃহস্পতিবার দুপুরে সাভারের আশুলিয়ার গণকবাড়ি এলাকায় এনআইবির সেমিনারকক্ষে এসব প্রাণীর পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের বিষয়টি জানান এনআইবির কর্মকর্তারা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। এ সময় এনআইবির মহাপরিচালক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সলিমুল্লাহ, সেন্টার ফর নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যানালাইটিকস প্রকল্পের পরিচালক কেশব চন্দ্র দাশ, এনআইবির বায়োইনফরমেটিকস বিভাগের ইনচার্জ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেন, এনআইবি ও গবেষণা দলের অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘আমরা কিন্তু সার্বিকভাবেই এই দেশটাকে নিয়েই ভাবি। দেশের মাটি, মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা—সবকিছুই কিন্তু বায়োটেকনোলজির মধ্যে পড়ে। তাই আমরা চাচ্ছি যে দেশটাকে এবং আমাদের যেই জিনিসগুলো রয়েছে, সেগুলোকে ভালোভাবে জানতে। যেন আমরা বিশ্বের কাছে গর্বের সঙ্গে সেগুলো তুলে ধরতে পারি।’ মন্ত্রী আরও বলেন, ‘তরুণেরা আজ গবেষণায় যুক্ত হয়ে দিনরাত কাজ করছেন। এতে কাঙ্ক্ষিত ফলও পাচ্ছি আমরা। এই ধরনের জিনোম বিশ্লেষণ প্রযুক্তি দেশের প্রাণিসম্পদশিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
তিন প্রাণীর জীবনরহস্য উন্মোচনের কাজটি করেছে এনআইবির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং মহাপরিচালক মো. সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার তথ্য তুলে ধরে একটি সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এনআইবির বায়োইনফরমেটিকস বিভাগের ইনচার্জ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ২ কোটি ৫৭ লাখ গরু, ১৯ লাখ ভেড়া ও ৩ কোটি ৪১ লাখ হাঁস রয়েছে। মোট জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে আসে, যা এটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ গবাদি প্রাণী, হাঁস-মুরগি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে শুধু গরু-মহিষ পালন করছে ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার। ছাগল-ভেড়া পালন করছে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ ও হাঁস-মুরগি পালন করছে ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার। এ গবেষণার ফলে এই খাতে আরও সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
গবেষণায় তিন প্রাণীর বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে উল্লেখ করে বলা হয়, দেশি মিরকাদিম গরুর চোখের পাতা ও খুর গোলাপি, ত্বকের রঙ প্রধানত সাদা, লেজের অগ্রভাগ বাদামি, শিং ছোট থেকে মাঝারি বাঁকা ও অগ্রভাগ সূক্ষ্ম। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক দেশীয় ভেড়ার ওজন হয় ২০ কেজি, লোম মসৃণ ও একদিকে বিন্যস্ত ও ক্রিমি সাদা বর্ণের হয়। এ ছাড়া হাঁসের রং হয় কালচে বাদামি, কালো ও সাদা পালকের মিশ্রণ, ঠোঁটের রং হয় হলুদাভ কালো, পায়ের পাতা হয় উজ্জ্বল কমলা রঙের।
গবেষকেরা জানান, মিরকাদিম জাতের গরুটির জিনোমের দৈর্ঘ্যে ২২৩, ৪৫, ৩২, ৮৫৬ জোড়া নিওক্লিউটাইড পাওয়া গেছে। মিরকাদিম জাতটির ভারতের জেবু জাতের সঙ্গে মিল রয়েছে। এ ছাড়া এটির নিজস্ব জেনেটিক বৈশিষ্ট্যও উঠে আসে গবেষণায়। গরুর মাংস উৎপাদনসংক্রান্ত পাঁচটি জিনের তথ্য পেয়েছেন গবেষকেরা, যা মাংস উৎপাদনের তথ্যে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে ভেড়া ও হাঁসের জিনোম অ্যাসেম্বলি ও বিশ্লেষণ শেষে ভেড়ার জিনোমের দৈর্ঘ্যে ২৮৬, ৯৪, ৭৯, ৯২৫ জোড়া নিউক্লিওটাইড এবং হাঁসে ১৩৩, ০৬, ৫৪, ৭৩৫ জোড়া নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে। গবেষণার এসব তথ্য গত ২৩ মার্চ ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে নিবন্ধন করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এনআইবির মহাপরিচালক সলিমুল্লাহ বলেন, ‘মিরকাদিম গরুর জেনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি এর বৈশিষ্ট্যগুলো কী। কাজেই জিনোম সিকোয়েন্স থেকে প্রাপ্ত ইনফরমেশনগুলো অ্যানালাইসিস করে পরবর্তী সময়ে আমরা সিলেকটিভ ব্রিড তৈরি করা থেকে শুরু করে অন্যান্য জাত ডেভেলপ করতে পারব। এ ছাড়া গবাদিপশুর সেসব জিনগত বৈশিষ্টের জন্য অধিক মাংস বা দুধ উৎপাদিত হয়ে থাকে, সেগুলোকে শনাক্ত করে তা অন্যান্য প্রাণীতে স্থানান্তর করতে পারব। এটি আমাদের দেশের নিজস্ব জাতের যেসব গবাদিপশু, প্রাণী আছে, সেগুলোকে রক্ষা করার পাশাপাশি দেশের প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করবে।’
সংবাদ সম্মেলনে এনআইবির কর্মকর্তারা জানান, জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির অগ্রগতি ইতিমধ্যে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন ফসল, পশুসম্পদ ও জীবাণুর জিনোম সিকোয়েন্স করার মাধ্যমে গবেষকেরা বিভিন্ন জীবের জেনেটিক গঠন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারছেন। এসব তথ্য বিভিন্ন জীবের উৎপাদনশীলতা, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও পুষ্টির মান উন্নত করতে সাহায্য করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য জেনোম সিকোয়েন্সিং এবং সেই সঙ্গে জেনোম এডিটিং প্রযুক্তিগুলো শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে পাট, মহিষ, ইলিশ, করোনাভাইরাসসহ বিভিন্ন জীবাণুর জেনোম সিকোয়েন্স ঘোষণা করা হলেও সিংহভাগই বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এসব সিকোয়েন্সের অধিকাংশের অ্যাসেম্বলিং ও অ্যানোটেশনের কাজও বিদেশি সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে।
গত ১২ জানুয়ারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান আশুলিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতে দেশি জাতের তিনটি প্রাণীর জেনোম সিকোয়েন্সিং কার্যক্রমের সূচনার মাধ্যমে ‘সেন্টার ফর নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যানালাইটিকস’ গবেষণাগার উদ্বোধন করেন।
গবেষণাগারটি মূলত সেন্টার ফর নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যানালাইটিকস প্রকল্পের আওতায় করা হয়। প্রকল্পের আওতায় মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জীবসম্পদের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গবেষণাগার, তথ্য বিশ্লেষণ ও তথ্য সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।