বাবা মন্টু কুমার দাসের সঙ্গে সজীব চন্দ্র দাস। শুক্রবার কমলাপুর রেলস্টেশনে | ছবি: সজীব চন্দ্র দাসের সৌজন্যে |
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাবা মন্টু কুমার দাস রেলওয়েতে অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর চাকরির বয়স প্রায় ৩০ বছর। চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন খালাসি হিসেবে। ছেলে সজীব চন্দ্র দাসও রেলওয়ের কর্মকর্তা। তাঁর পদবি পরিচালক; চাকরির বয়স ৯ বছর। চাকরিক্ষেত্রে বাবার ‘বস’ ছেলের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, বাবার সঙ্গে একই ট্রেনে একদিন দায়িত্ব পালন করবেন। অবশ্য প্রসঙ্গটি উঠলেই বাবা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, ছেলের অধীন কাজ করার আগেই তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে যাবেন। তবে হয়তো তিনিও তেমন একটা দিনের অপেক্ষায় ছিলেন। অবশেষে দিনটি এল। ১১ আগস্ট (শুক্রবার) বাবা ও ছেলে একই ট্রেনে দায়িত্ব পালন করলেন।
সজীব চন্দ্র দাস দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাবার সঙ্গে তাঁর ছবিসহ পোস্ট দিয়ে স্বপ্ন পূরণের কথা লিখেছেন।
আজ রোববার সকালে কথা হলো সজীব চন্দ্র দাসের সঙ্গে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে (বিবিএ) স্নাতক করা সজীব বলেন, ‘বাবার ইচ্ছাতেই রেলের চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমাদের ফেনী জেলা থেকে পাস করা একমাত্র প্রার্থী ছিলাম আমি। চাকরি পাওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন ছিল, একই ট্রেনে বাবার সঙ্গে এক দিন হলেও কাজ করব। এ জন্য আট বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো। পণ্যবাহী ট্রেন, লোকাল ট্রেনসহ বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে আমি প্রথম যেদিন আন্তনগর ট্রেনের দায়িত্ব পেলাম, সেদিনই বাবার সঙ্গে একই ট্রেনে দায়িত্ব পালন করলাম।’
বাবা মন্টু কুমার দাসের সঙ্গে একই ট্রেনে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে সজীব চন্দ্র দাসের দেওয়া ফেসবুক পোস্ট | ছবি: সংগৃহীত |
সজীব জানান, গত শুক্রবার বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া সিলেটগামী ‘জয়ন্তিকা’ আন্তনগর ট্রেনে (৭১৭) তিনি পরিচালক, আর তাঁর বাবা অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মন্টু কুমার দাস ও সজীব চন্দ্র দাস দুজনই কমলাপুর রেলস্টেশনে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর বাবা আগে থেকেই আন্তনগর ট্রেনে দায়িত্ব পালন করেন উল্লেখ করে সজীব বলেন, ‘আমি যেদিন আন্তনগরের দায়িত্ব পেলাম, সেদিনই খোঁজ নিলাম বাবা কোন ট্রেনের দায়িত্বে আছেন। জানতে পারলাম, আমি আর বাবা একই ট্রেনের দায়িত্বে আছি। রাতে (গত বৃহস্পতিবার) বাবাকে কিছু বললাম না। পরদিন (শুক্রবার) সকালে বাবা আগে বের হন, তখনো কিছু বলিনি। পরে আমি যখন কমলাপুর স্টেশনে গেলাম, ট্রেনটি ছিল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে। আমাকে সেখানে দেখে বাবা এগিয়ে আসছিলেন। তিনি তাঁর ছেলেকেই দেখছেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। বাবা কাছাকাছি আসতেই প্রণাম করলাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।’
সজীব জানান, তাঁর বাবা খুবই অবাক হয়েছিলেন। রাজধানীর মানিকনগরের একই বাসা থেকে তাঁরা সকালে বের হয়েছেন। অথচ তাঁর বাবা এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। পরে ট্রেনে বাবা ও ছেলের আলাদা দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। সজীব টিকিট পরীক্ষকদের (টিটি) সঙ্গে যাত্রীদের টিকিট ঠিক আছে কি না, তা তদারক করেন। আর বাবা তাঁর বগিতে যাত্রীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করেন। একসময় টিকিট পরীক্ষা করতে করতে ছেলে বাবার বগিতে চলে আসেন।
ট্রেনের ভেতরে বাবা ও ছেলে একসঙ্গে কাজ করছেন—এমন সময়ের কোনো ছবি তুলেছেন কি না, জানতে চাইলে সজীব বলেন, আসলে কাজের সময় ছবি তোলার কথা মনে ছিল না। তবে ট্রেন ছাড়ার আগে স্টেশনে তাঁরা ছবি তুলেছেন।
চাকরিক্ষেত্রে বাবার ওপরের পদে কাজ করার বিষয়টি তুলতেই সজীব বললেন, ‘বাবা তো বাবাই। সেখানে “বস” বলে কিছু নেই। স্টেশনে সবার সামনেই বাবাকে প্রণাম করি।’
সজীবরা দুই ভাই, এক বোন। বড় ভাই বাক্প্রতিবন্ধী। বোন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মা সীমা রানী দাসসহ পরিবারের সবাই একসঙ্গে থাকেন। দুই বছর হলো সজীব বিয়ে করেছেন। স্নাতকপড়ুয়া স্ত্রী পড়াশোনার ফাঁকে সংসারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
ছোটবেলা থেকেই সজীব দেখছেন, বাবা মন্টু দাস অনেক কষ্ট করছেন। কাজের জন্য বের হয়ে গেলে দু–এক দিন পর বাড়ি ফিরতেন। এ কারণে সেভাবে বাবাকে কাছে পাননি তিনি। তাই তাঁর নিজেরও রেলওয়েতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না। তবে বাবার ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাতেই পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এখন বাবার মতো সজীবেরও জীবনের রুটিন একই রকম। সেই অর্থে পরিবারকে সময় দেওয়া যায় না। শুক্র-শনি বা ঈদ-পূজা বলতে আসলে কিছু নেই। ছুটি পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
রেলে পোষ্য কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা আছে উল্লেখ করে সজীব বলেন, ‘পোষ্য কোটায় চাকরি পেতে হলেও যোগ্যতা লাগে। অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই টিকতে হয়। অথচ একদল এই পোষ্য কোটায় চাকরি পাওয়া নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ করেন। আমার ভাই কিন্তু চাকরি পাননি।’
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সজীব চন্দ্র দাস | ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে |
সজীব জানান, অভাব-অনটনের জন্য বড় ভাই পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়তে পারেননি। আর তিনি নিজে টিউশনি করে, বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। তাঁর চাকরি পাওয়ার পর থেকে পরিবার সুখের মুখ দেখা শুরু করেছে।
মন্টু কুমার দাস ২০২৫ সালের প্রথম দিকে চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। এর আগেই বাবার সঙ্গে কাজ করতে পারলেন, এটা তাঁর জীবনের স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে বলে জানান সজীব। বাবার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হচ্ছে নিজে প্রথম আন্তনগর ট্রেনে কাজ করছি ট্রেন পরিচালক হিসেবে আর সঙ্গে ছিলেন আমার বাবা অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে। এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম...সারপ্রাইজ দিলাম আর প্ল্যাটফর্মেই বাবার পা ধরে নমস্কার করলাম। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। আমার এই অনুভূতি সবাই জানুক, তাই প্রকাশ করা। আমার বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন।’