ঘটনাচক্রে যে মিষ্টির জন্ম, সেটি এখন বাংলাদেশের জিআই পণ্য

নাটোরের লালবাজারে প্রভাত পালের দোকানে তৈরি করা হচ্ছে কাঁচা গোল্লা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

ঢাকা ও নাটোর  প্রতিনিধি: নাটোরের ঐতিহ্য কাঁচাগোল্লা পেল ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। আজ বৃহস্পতিবার নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে দেশের ১৭তম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

নাটোরের কাঁচাগোল্লা প্রায় আড়াই শ বছর ধরে একই স্বাদ ও ঘ্রাণ নিয়ে টিকে আছে। যদিও এই মিষ্টান্নের জন্ম হয়েছিল ঘটনাচক্রে।

পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) কাঁচাগোল্লাকে স্বীকৃতি দিয়ে গত ৭ জুলাই একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, নাটোরের পানি, দুধ ও তৈরির বিশেষ প্রক্রিয়া ছাড়া নাটোরের কাঁচাগোল্লার আদি বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা যায় না। নাটোরের সীমানা পেরিয়ে এর সুখ্যাতি সারা দেশে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি। এরপর একে একে ঢাকাই মসলিন, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, নেত্রকোনার বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বাংলাদেশি কালিজিরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, ইলিশ, বাগদা চিংড়িসহ ১৭টি পণ্য জিআই সনদ পায়।

আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে ডিপিডিটি এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।

কাঁচাগোল্লার জিআই নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন নাটোরের সাবেক ও বর্তমানে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। গত ৩০ মার্চ হলফনামা সম্পাদনের মাধ্যমে ডিপিডিটিতে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ৮ আগস্ট কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতি অনুমোদন করা হয়।

নাটোর শহরের প্রবীণ মিষ্টি কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৭৬০ সালের দিকে নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার মধুসূদন পালের মিষ্টির দোকান ছিল এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ দোকান। দোকানের বড় বড় চুলায় মধুসূদন পাল প্রতিদিন দেড় থেকে দুই মণ ছানা দিয়ে পানতোয়া, চমচম, কালোজাম ইত্যাদি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন ১০-১৫ জন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির।

নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে মধুসূদন পাল ছানায় চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। জ্বাল দেওয়ার পর সেটা মুখে দিয়ে দেখা যায়, ওই চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। তাৎক্ষণিক তিনি এর নাম দেন কাঁচাগোল্লা। সৃষ্টি হয় এক নতুন মিষ্টান্ন।

সেই ১৭৬০ সালে বাংলার শাসনকর্তা মহারানি ভবানীর রাজত্বকালে এই কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানতোয়া প্রভৃতি মিষ্টি ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজপরিবারেও এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র।

ঐতিহ্যবাহী এই কাঁচাগোল্লা দীর্ঘদিন ধরে বিকৃত আকারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়ে আসছিল। তবে এ নিয়ে নাটোরের মানুষের করণীয় কিছুই ছিল না। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের প্রসিদ্ধ একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাটোরে তাদের বিক্রয়কেন্দ্রে গোলাকার কাঁচাগোল্লা বিক্রি শুরু করে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।

নাটোরের সুধীমহল থেকে কাঁচাগোল্লা বিকৃত করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করা হয়। এ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কাঁচাগোল্লার জিআই সনদ নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জিআই স্বীকৃতির পর এই বিকৃত উৎপাদন বন্ধ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, অবশেষে জিআই স্বীকৃতি এল। নাটোরের এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের স্বীকৃতিতে ভূমিকা রাখতে পেরে তিনি আনন্দিত।

চার পুরুষ ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নাটোরের ঐতিহ্যবাহী জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার। জিআই স্বীকৃতির ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এই দোকানের বর্তমান স্বত্বাধিকারী প্রভাত কুমার পাল বলেন, জিআই স্বীকৃতির আবেদন অনেক আগেই করা দরকার ছিল। কেননা, বিভিন্ন ধরনের মানহীন মিষ্টি কাঁচাগোল্লা নামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়। এতে নাটোরের সুনাম নষ্ট হয়। তিনি বলেন, এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বিকৃত আকারে উৎপাদন বন্ধ হবে। দেশের মানুষ আসল কাঁচাগোল্লা চিনে কিনতে পারবেন।

নাটোরের মিষ্টির দোকানে ভালো মানের কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬০০ টাকার কমবেশি দামে। তবে ৩০০ টাকায়ও নাটোরে কাঁচাগোল্লা নাম দিয়ে মিষ্টান্ন বিক্রি হয়। তবে তাতে কাঁচাগোল্লার আসল স্বাদ পাওয়া যায় না।

নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা বলেন, নাটোরের ঐতিহ্য ধরে রেখে উৎপাদকেরা কাঁচাগোল্লা প্রস্তুত করেন। কিন্তু বাইরে বিকৃত আকারে কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয় বলে বিভিন্ন সময় শোনা যায়। জেলা প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখবে।