জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন ভারত সফরে, তখন রওশন এরশাদের নামে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দলটিতে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন—এ খবর দলটিতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। যদিও জাপার মহাসচিবসহ দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। রওশন এরশাদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ-সংক্রান্ত খবরটি ‘ভুয়া’। তবে এ বিষয়ে রওশন এরশাদ কিছু বলেননি।

এ ঘটনাকে দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে আবার নাটকীয়তার শুরু বলে মনে করছেন। বিশেষ করে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন ভারত সফরে, তখন হঠাৎ করে রওশনের নামে এমন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দলের ভেতরে এবং বাইরে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।

অনেকে বলছেন, এই মুহূর্তে কৌশলগত কারণে বিবৃতিটিকে নাকচ করা হলেও কার্যত এটিই শেষ কথা নয়। এ ধরনের তৎপরতা দলটিতে সক্রিয় রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে দলের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে বিভক্তি আরও দৃশ্যমান হবে। বিশেষ করে, নির্বাচন নিয়ে জি এম কাদেরের ভূমিকা কী হয়, এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। চার দিনের সফর শেষে জি এম কাদেরের আজ বুধবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তাঁর এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।

বিবৃতি, ভিডিও বার্তা, বিক্ষোভ

মঙ্গলবার দুপুরের দিকে রওশন এরশাদের জাপার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ-সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে আসে। জাতীয় পার্টির প্যাডে রওশনের সই করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমি...ঘোষণা করছি যে পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’

আড়াই লাইনের ওই বিবৃতিতে রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন। কাজী লুৎফুল কবীর নামের এক ব্যক্তি ‘প্রেস নোট (জাপা) ’ নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই বিবৃতিটি দেন। লুৎফুল কবীর দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রুপে রওশন এরশাদসহ তাঁর পক্ষের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে আসছেন।

এই বিবৃতির পাশাপাশি রওশনকে চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত-সম্পর্কিত সভার কার্যবিবরণী এবং তাতে পাঁচজন কো–চেয়ারম্যান ও একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের স্বাক্ষরসংবলিত একটি ছবিও দেন। 

এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হকসহ তিনজন নেতা এই বিবৃতিকে ‘ভুয়া’ বলে দাবি করেন। এ বিষয়ে জাপার মহাসচিব, দলের কো–চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সফিকুল ইসলাম পৃথক বিবৃতি ও ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। গণমাধ্যমে পাঠানো এসব বার্তায় তাঁরা বলেছেন, জি এম কাদেরই জাপার চেয়ারম্যান। তাঁর নেতৃত্বেই দল ঐক্যবদ্ধ আছে।

বিবৃতি ও ভিডিও বার্তায় জাপার মহাসচিব বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ ইচ্ছা করলেই চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দিতে পারেন না। গঠনতন্ত্রের বাইরে কেউই কিছু করতে পারবেন না। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছেন। জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত কিছু ব্যক্তি ম্যাডামের (রওশন এরশাদ) নাম ব্যবহার করে এমন একটি ভুয়া খবর দিয়েছেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং ঘটার সুযোগও নেই। তিনি ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত না হতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে দেওয়া এই বিজ্ঞপ্তিকে দলের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করেছে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা। মঙ্গলবার দুপুরে বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনের সড়কে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

এবারই প্রথম নয়
অবশ্য রওশন এরশাদের নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করার ঘটনা এই প্রথম নয়। এবারসহ অন্তত তিনবার তিনি নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। জেনারেল এরশাদ মারা যান ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর রওশন সংবাদ সম্মেলন করে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। তখন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হকসহ অনেকে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অপর দিকে জাপার আরেক অংশ জি এম কাদেরকে বৈধ চেয়ারম্যান ঘোষণা করে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন। এই পক্ষে ছিলেন জিয়াউদ্দিন বাবলু, মসিউর রহমানসহ (রাঙ্গা) অনেকে। পরে দুই পক্ষের সমঝোতা হয়।

এরপর ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি রওশন এরশাদ ছেলে সাদ এরশাদকে কো–চেয়ারম্যান করে ১৬ জন নেতাকে দলে পদায়ন করে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠান। যদিও তাঁর এ পদায়ন জি এম কাদের গ্রহণ করেননি। এ ছাড়া গত বছরের ৩১ আগস্ট ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিজেকে আহ্বায়ক করে জাপার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করেন রওশন।

এ নিয়ে দলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় জি এম কাদের তিন মাস দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকেও বিরত ছিলেন। 

এরপর গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ১৪ ডিসেম্বর রাতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে রওশন এরশাদকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন তাঁর পক্ষের নেতারা।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রতিবারই গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতি বা বিজ্ঞপ্তিকে অস্বীকার করা হয়। তবে এবার রওশন এরশাদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করার বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে পাল্টা কোনো বিবৃতি দেননি। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হয়।

তাঁকে মুঠোফোনে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। তবে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, এটি একটি ভুয়া বিবৃতি। বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য কেউ এটা করে থাকতে পারেন।

রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ ও জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, কৌশলগত কারণে রওশন এরশাদের অনুসারী নেতারা বিবৃতিকে অস্বীকার করছেন। কারণ, ‘অসময়ে’ রওশনের এই অবস্থান প্রকাশ নিয়ে সরকারি মহল থেকেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে। কার্যত এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পরই নেতারা বিবৃতি এবং ভিডিও বার্তা দিয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানান।

জাপার কো–চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র হতে থাকে। আমরা তো জন্ম থেকেই জ্বলছি এবং মোকাবিলা করে আসছি। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, সমস্যা আরও আসবে। এসব বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’

তবে নির্বাচন এলে প্রতিবারই জাতীয় পার্টিতে নানা তৎপরতা চলে, এবারও এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না।