নাটোরের কাঁচাগোল্লার ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির খবরে মিষ্টিপ্রেমীরা একে অন্যকে আপ্যায়ন করেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি নাটোর: আড়াই শ বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্যে মাখা নাটোরের কাঁচাগোল্লা ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের হাতে এই স্বীকৃতিপত্র পৌঁছানোর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উচ্ছ্বাস শুরু হয় নাটোরবাসীর। মিষ্টিপ্রেমীরা কাঁচাগোল্লা কিনে একে অন্যকে আপ্যায়ন করেন। কাঁচাগোল্লার কারিগর, ব্যবসায়ী-কর্মচারীরাও এই স্বীকৃতিতে খুশি।

কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এসব বিবেচনায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে স্বীকৃতি দিয়ে গত ৭ জুলাই একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, নাটোরের পানি, দুধ এবং তৈরির বিশেষ প্রক্রিয়া ছাড়া নাটোরের কাঁচাগোল্লার আদি বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। সর্বশেষ ৮ আগস্ট নাটোরের কাঁচাগোল্লাকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনের চিঠি নাটোরের জেলা প্রশাসকের হাতে এসে পৌঁছায়।

জিআই পণ্য হিসেবে কাঁচাগোল্লার স্বীকৃতি লাভের খবর শোনার পর শহরের মিষ্টির দোকানগুলোতে কারিগরদের সঙ্গে দোকানমালিক ও কর্মচারীদের আলিঙ্গন করতে দেখা যায়। কোনো কোনো দোকানে উপস্থিত লোকজনকে বিনা মূল্যে কাঁচাগোল্লা খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয়। খুশির খবরে পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে অনেকে কাঁচাগোল্লা কিনতে ছুটে যান মিষ্টির দোকানে। অফিস আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও কাঁচাগোল্লা খাওয়ার ধুম পড়ে।

মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডারে কাঁচাগোল্লা কিনতে আসেন গৃহবধূ কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, তাঁর বাসায় আজ শুক্রবার মিষ্টির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু কাঁচাগোল্লার ভৌগোলিক স্বীকৃতির খবর শহরময় আলোচিত হওয়ায় এটি খেতে ইচ্ছা করছিল। তাই তিনি পরিবারের জন্য কাঁচাগোল্লা কিনতে এসেছেন।

জয়কালীবাড়ি মিষ্টান্ন ভান্ডারে কথা হয় প্রিয়তি রানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের খুশির দিন। আমাদের একটা পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল। দিনটিকে স্মরণীয় করতেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাঁচাগোল্লা খেতে এসেছি।’

চার পুরুষ ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নাটোরের ঐতিহ্যবাহী জয়কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার। জিআই স্বীকৃতির ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এই দোকানের বর্তমান মালিক প্রভাত কুমার পাল বলেন, ‘বংশপরম্পরায় কাঁচাগোল্লার সঙ্গে আমাদের আবেগ ও সম্মান জড়িয়ে আছে। জিআই স্বীকৃতিতে আমাদের সম্মান বাড়ল। আমরা গর্বিত।’ মাদ্রাসা মোড়ের সূর্য মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক সুজন কুমার বলেন, ‘জিআই স্বীকৃতি আমাদের ভালো কাঁচাগোল্লা বানানোর দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’

নাটোরের ঐতিহ্যবাহী এই কাঁচাগোল্লা সৃষ্টির পেছনে আছে প্রাচীন গল্পগাথা। শহরের প্রবীণ মিষ্টির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৭৬০ সালের দিকে নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার মধুসূদন পালের মিষ্টির দোকান ছিল এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ দোকান। দোকানের বড় বড় চুলায় মধুসূদন পাল প্রতিদিন দেড় থেকে দুই মণ ছানা দিয়ে পানতোয়া, চমচম, কালোজাম ইত্যাদি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন ১০-১৫ জন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেননি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে মধুসূদন পাল ছানায় চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। জ্বাল দেওয়ার পর সেটা মুখে দিয়ে দেখা যায়, ওই চিনিমেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। তাৎক্ষণিক তিনি এর নাম দেন কাঁচাগোল্লা। সৃষ্টি হয় এক নতুন মিষ্টান্ন।

সেই ১৭৬০ সালে বাংলার শাসনকর্তা মহারানি ভবানীর রাজত্বকালে এই কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানতোয়া প্রভৃতি মিষ্টি ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। এর ফলে সে সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজপরিবারেও এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র।

নাটোরের লাঠি-বাঁশি ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, আড়াই শ বছরের বেশি সময় ধরে নাটোরের কাঁচাগোল্লা দেশে–বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। অবশেষে নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদের হাত ধরে কাঁচাগোল্লা জিআই স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখন ব্যবসায়ীদের উচিত হবে, কাঁচাগোল্লার আদি গুণগত মান অটুট রাখা। তিনি জিআই স্বীকৃতি অর্জনের জন্য সাবেক ও বর্তমান জেলা প্রশাসক এবং ব্যবসায়ীদের অভিনন্দন জানান।

নাটোরের সাবেক ও রাজশাহীর বর্তমান জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদ বলেন, ‘কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতি লাভে অবদান রাখতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। কারণ, এটা শুধুই একটা মিষ্টির নাম নয়। এটা সমগ্র নাটোরবাসী তথা দেশবাসীর আবেগের একটা ব্যাপার।’ এই অর্জনের জন্য তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, গণমাধ্যম বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছিল।

কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এর মান অটুট রাখতে প্রশাসন কাজ করবে বলে জানিয়েছেন নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঞা। তিনি বলেন, কাঁচাগোল্লা জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় জেলা প্রশাসক হিসেবে তিনি ভীষণ খুশি হয়েছেন। মিষ্টি ব্যবসায়ীদের এই সুনাম ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সততার সঙ্গে ব্যবসা করার আহ্বান জানান তিনি।