পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তলব: অসন্তোষ জানাল সরকার, অবস্থান ব্যাখ্যা রাষ্ট্রদূতদের

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

কূটনৈতিক প্রতিবেদক: ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলা নিয়ে ইইউসহ ১৩ বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সরকারের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। সরকারকে পাশ কাটিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘অকূটনৈতিক’ আচরণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা কোন প্রেক্ষাপটে হিরো আলমকে নিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটা ব্যাখ্যা করেন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে তাঁদের অবস্থান অটুট থাকার কথাও জানান।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বুধবার সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকদের নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের বিষয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলাকালে বনানীর একটি কেন্দ্রে গিয়ে হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম। কেন্দ্রের বাইরে রাস্তায় ফেলে তাঁকে পিটিয়েছিলেন নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারীরা। ১৯ জুলাই ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) একটি যৌথ বিবৃতি দেয়।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বুধবারের ব্রিফিংয়ের শুরুতে সরকারের অবস্থান জানিয়ে একটি নোট আমন্ত্রিত রাষ্ট্রদূতদের পড়ে শোনানো হয়। এরপর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও কূটনীতিকেরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আমন্ত্রিত কূটনীতিকদের মধ্যে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত অ্যান ফন লুইয়েন এবং ঢাকায় ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি ওই বিবৃতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। কোন প্রেক্ষাপটে এবং কেন তাঁরা বিবৃতিটি দিয়েছিলেন, সেটি ব্রিফিংয়ে জানান বিদেশি কূটনীতিকেরা।

ব্রিফিংয়ের পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে ১৩টি দূতাবাস গণমাধ্যমে একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল। রাষ্ট্রদূতদের আমরা ডেকেছিলাম। তাঁদের কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণে আমরা আমাদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছি।’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, হিরো আলমের ওপর হামলা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা দিয়ে সারা দিনের শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। হিরো আলম ওই দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে অবাধে ঘুরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভোট শেষ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হননি বা কোনো অভিযোগ করেননি।

শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘তাই শুধু একটি কেন্দ্রের শেষ মুহূর্তের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে গুটিকয় কূটনীতিক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা কখনোই সারা দিনের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রতিফলিত করে না। দ্রুত একটি প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের মূল্যায়নটির বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেননি।’

হিরো আলমের ওপর হামলা সম্পর্কে জানার পরপরই নির্বাচন কমিশন ও সরকার দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ১৯ জুলাই কূটনীতিকেরা যৌথ বিবৃতি দেওয়ার অনেক আগেই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৮ জুলাই তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও কূটনীতিকেরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যা ‘অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয়’।

শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘যে দ্রুততা ও গুরুত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ঘটনাটির সমালোচনা তাঁরা করেছেন, সেই গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু তাঁরা সরকারের গৃহীত তাৎক্ষণিক ও ত্বরিত আইনানুগ ব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করেননি। তাই যৌথ বিবৃতিটির বস্তুনিষ্ঠতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকেই যায়।’

যৌথ বিবৃতিটি ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে যথা সময়ের অনেক আগেই তড়িঘড়ি করে অপরিণতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আশা করি, আমাদের আজকের আলোচনার পর তাঁরা সেটি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন এবং ভবিষ্যতে এমন অকূটনৈতিক আচরণ থেকে বিরত থাকবেন।’

বিদেশি মিশনপ্রধানদের কূটনৈতিক আচরণবিধি-সম্পর্কিত ভিয়েনা কনভেনশন স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁদের গঠনমূলক হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

 বুধবারের ব্রিফিংয়ে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিজয়ী প্রার্থীর কাছ থেকে কূটনীতিকদের কিছু জানার থাকলে সেটা জানানোর জন্যই মোহাম্মদ এ আরাফাত কিছু সময় বিফ্রিংয়ে ছিলেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার ই-মেইলে বলেন, ‘বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্য পূরণে আমাদের সমর্থনের বিষয়টি বারবার বলে আসছি। এ লক্ষ্যেই অন্যান্য বিদেশি মিশনের সঙ্গে যৌথভাবে হিরো আলমের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছি। ওই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনায় মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই।’

বৈঠকের বিষয়ে ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের পক্ষ থেকে ই-মেইলে এই প্রতিবেদককে বলা হয়, হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়ে ১৩ বিদেশি মিশনের যৌথ বিবৃতির বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ই-মেইলে এর বাইরে কিছু বলা হয়নি।