বিশেষ প্রতিবেদক: বাংলাদেশে বায়ু ও প্লাস্টিক দূষণ তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে ওই দূষণ মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার তুলনায় ১৬ গুণ বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে। অন্যদিকে ২০০৫ সালে ঢাকায় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৯ কেজি ২০০ গ্রাম, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২২ কেজি ২৫০ গ্রাম।

ব্যবহার হওয়া এসব প্লাস্টিকের বড় অংশই প্রকৃতিতে জমা হচ্ছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হচ্ছে। আবার দেশের উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে, ৩৯ শতাংশ। এরপর রূপসা নদীতে, প্রায় ৩২ শতাংশ।

দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রোববার সংস্থাটির ঢাকার কার্যালয়ে এক কর্মশালায় চলমান ওই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে আরও জানানো হয়, বিশ্বের যে ২০টি দেশে ব্যবহার করা প্লাস্টিক সামগ্রী সবচেয়ে বেশি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফেলে দেওয়া হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ফলে এসব প্লাস্টিক বাংলাদেশের মাটি, পানি, মাছ ও উদ্ভিদের ক্ষতির পাশাপাশি জলাবদ্ধতা তৈরি করছে।

গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা ফেলো ইউসুফ সাদাত। কর্মশালায় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সূচনা ও সমাপনী বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির গ্রিন সিটি ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ‘প্রমোটিং গ্রিন সিটিজ থ্রু অ্যাওয়ারনেস বিল্ডিং অন এয়ার অ্যান্ড প্লাস্টিক পলিউশন’ শীর্ষক কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়।

কর্মশালায় সূচনা বক্তব্যে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বাংলাদেশের বায়ু ও প্লাস্টিক দূষণ বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে তৈরি হচ্ছে। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এ সমস্যা মোকাবিলায় কাজ করছে। তবে এসব কাজ আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন দরকার। সিপিডির পক্ষ থেকে সেই উদ্দেশ্যেই এই গবেষণা করা হচ্ছে। এই গবেষণা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য নীতিসহায়ক হবে।’

গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা শহরে বর্ষাকালে যে বৃষ্টি হয়, তা ৬৫টি খালের মাধ্যমে নদীতে গিয়ে পড়ে। কিন্তু এসব খালের ২২টি প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি নামতে না পারায় ঢাকায় জলাবদ্ধতা বাড়ছে। দেশের উপকূলীয় নদ-নদীগুলোতে প্রতিবছর ১০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে, যা নদীগুলোর মাছের পেটে মাইক্রো প্লাস্টিক হিসেবে জমা হচ্ছে। এসব অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। তৈরি করছে উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগ।

উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে, ৩৯ শতাংশ। এরপর রূপসা নদীতে, প্রায় ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশের বেশির ভাগ উপকূলীয় নদীর উৎসস্থল হচ্ছে উজানে থাকা অন্য দেশে। এসব অভিন্ন নদ-নদী দিয়ে অন্য দেশ থেকেও প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশে আসছে।

গবেষণায় আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির পর দেশের মানুষের মধ্যে মাস্ক, গ্লাভসের ব্যবহার বেড়েছে। এসব পণ্য একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব পণ্য প্লাস্টিকের তৈরি। আর কমপক্ষে তিন দিন সেখানে জীবাণু থেকে যায়। যে কারণে একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়ার পর তা নদী ও মাটি দূষণ করার পাশাপাশি অন্য মানুষদের মধ্যেও জীবাণু ছড়িয়ে দিচ্ছে।

গবেষণায় প্লাস্টিক দূষণের আর্থিক ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো পর্যটনের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সেখানে প্লাস্টিক দূষণের কারণে পর্যটকেরা যেতে চান না। যে কারণে বছরে দুই কোটি ডলারের পর্যটন আয় কম হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ২০২০ সালে ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে এসব বর্জ্য পরিষ্কার করার কাজে; যা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেটের ৩০ শতাংশ।

কর্মশালায় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্লাস্টিক ও বায়ুদূষণ নিয়ে সরকারি তথ্যে ঘাটতির কথা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, দেশের বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা ও কালো ধোঁয়া বের করে এমন গাড়ির সংখ্যার প্রকৃত তথ্য দেওয়া হয় না। একই সঙ্গে মেট্রোরেল ও উড়ালসড়কের মতো বড় অবকাঠামো এবং বেসরকারি মালিকানার ভবন নির্মাণের মাধ্যমে প্রচুর বায়ুদূষণ হয়। এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরকে বেশি সক্রিয় দেখা যায় না।

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বায়ুদূষণের এক দিনের পুরোনো তথ্য দেওয়া হয় এমন বক্তব্য দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা বলেন, অথচ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রতি মুহূর্তের দূষণের তথ্য এবং এলাকাভিত্তিক চিত্র তুলে ধরছে। এ ছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোর দুর্বলতার কারণেও দূষণ বেশি হচ্ছে।