যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের’ জয়গান বাইডেন-মোদির মুখে

হোয়াইট হাউসে করমর্দন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন  | ছবি: রয়টার্স

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: জাঁকজমক ও বর্ণিল আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের’ জয়গান গাইলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মোদির সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দুই দেশের সম্পর্ককে ‘একুশ শতকের’ জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য উদ্বেগ দেখিয়ে মোদিকে ভিসা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। সেই মোদিই এখন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, বিশেষ আমন্ত্রণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রটোকল নিয়ে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্রে। বাইডেনের সঙ্গে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার আগে তাঁর সম্মানে নানা আয়োজন করা হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে মোদিকে সশস্ত্র সালাম দেওয়া হয়। এরপর জমকালো নৈশভোজেও অংশ নেন মোদি। এর আগে হোয়াইট হাউসে পৌঁছালে জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন তাঁকে স্বাগত জানান। সেখানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও উপস্থিত ছিলেন। হোয়াইট হাউসে তাঁকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

অভ্যর্থনার আনুষ্ঠানিকতা শেষে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন নরেন্দ্র মোদি ও বাইডেন। মোদি সেখানে বলেন, ‘আমি তিন দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলাম এবং বাইরে থেকে হোয়াইট হাউস দেখেছিলাম। এই প্রথম ভারতীয়-আমেরিকানদের জন্য হোয়াইট হাউসের এই বিশাল ফটক খুলে দেওয়া হলো।’

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি কখনো সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে চাননি। এবারই প্রথম সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন তিনি। ভারতের গণতন্ত্র ও মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘গণতন্ত্র আমাদের চেতনা, রক্তে মিশে আছে। আমাদের সংবিধান, আমাদের সরকার ধর্ম, বর্ণ, জাতের ভিত্তিতে কোনো বিভেদ করে না।’

হোয়াইট হাউসের ব্যালকনি থেকে লোকজনের উদ্দেশে হাত নাড়ান নরেন্দ্র মোদি ও জো বাইডেন | ছবি: রয়টার্স

মোদিকে স্বাগত জানাতে অনেক ভারতীয় তখন হোয়াইট হাউসের সামনে ভিড় করেছিলেন। আবার একদল বিক্ষোভাকারীও মোদির সফরের বিরোধিতা করে সেখানে বিক্ষোভ করেন। এর আগে মোদি মার্কিন কংগ্রেসে বক্তব্য রাখেন। তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানান কংগ্রেসম্যানরা।

২০১৪ সালের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বিজেপি নেতা মোদিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মধ্যে নিজ স্বার্থ রক্ষায় আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করে ওয়াশিংটন। তবে এই মনোভাব কখনো পুরোপুরি মেনে নেয়নি দিল্লি।

কংগ্রেসে বক্তব্য দেওয়ার সময় চীনের নাম উল্লেখ না করে মোদি বলেন, জবরদস্তি এবং সংঘর্ষের কালো মেঘ ইন্দো-প্যাসিফিকের ওপর ছায়া ফেলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়েও রাশিয়ার নাম মুখে আনেননি মোদি। এই ইস্যুতে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপে যুদ্ধ ফিরে এসেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কোনো সমালোচনা করেনি মোদি সরকার। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সামরিক সরঞ্জাম আমদানিতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং মস্কোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিক্ষিত সম্পর্কের কারণেই রাশিয়ার বিপক্ষে যায় এমন কিছু বলছে না ভারত।

এর ফলে ওয়াশিংটন ও দিল্লির সম্পর্কে কিছু সময়ের জন্য টানাপোড়েন তৈরি করে। তবে গতকাল বাইডেনের গলায় ভিন্ন সুর শোনা গেছে। বাইডেন দুই দেশের ইতিবাচক সম্পর্কে মনযোগ দিতে বেশি আগ্রহী। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী। তিনি দুই দেশের সম্পর্ককে ‘একুশ শতকের অন্যতম সুস্পষ্ট সম্পর্ক’ হিসেবে অভিহিত করেন।

মার্কিন কংগ্রেসকে মোদি বলেন, এটি বিশ্বের দুটি বৃহৎ গণতন্ত্রের একত্রিত হওয়া। তিনি আরও বলেন, দুই দেশের বন্ধুত্ব সম্পর্ক ‘পুরো বিশ্বের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে’। দুই দেশের ব্যাপক এবং বিশ্ব-কৌশলগত অংশীদারিত্বে একটি ‘নতুন অধ্যায়’ যুক্ত হয়েছে।

তবে মোদির সফর সবাই উদ্‌যাপন করছে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এমন সময় যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন, যখন তিনি ভিন্নমত দমনের জন্য কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি। তাঁর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারও সংখ্যালঘুদের সহিংসতা ও বৈষম্য থেকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট কাজ করেনি বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অনেকে তাঁর এই সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। যদিও ভারতের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী প্রবাসী তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন, যাদের মধ্যে সিলিকন ভ্যালির সিইও রয়েছেন।

ঊষ্ণ সংবর্ধনা পান নরেন্দ্র মোদি | ছবি: রয়টার্স

বেশ কয়েকজন ডেমোক্র্যাট সদস্য কংগ্রেসে মোদির বক্তৃতা বয়কট করেছেন। তাঁদের একজন আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ টুইটারে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরের সময় এমন কোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রটোকল দেওয়া উচিত নয়, যার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

আড়ম্বর অনুষ্ঠান এবং প্যারেড ছাড়াও মোদির সঙ্গে বাণিজ্যক বিষয়েও আলোচনার অগ্রগতি হয় গতকাল। দুই দেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ছয়টি অসামান্য বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়েছে এবং জেনারেল ইলেকট্রিক এবং মাইক্রোনের সঙ্গে চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে।

মোদি হোয়াইট হাউসে যাওয়ার আগেই গতকাল সামরিক চুক্তির ঘোষণা আসে। যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের অ্যারোস্পেস ইউনিটের সঙ্গে ভারতের ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড’ (হ্যাল)-এর চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির ফলে যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরি করবে তারা। এই চুক্তির আওতায় জেনারেল ইলেকট্রিকের তৈরি ই-৪১৪ ইঞ্জিন এখন ভারতে তৈরি হবে।

এদিকে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চুক্তি সই হয়েছে গতকাল। এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মেমোরি চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোন টেকনোলজি ভারতে ৮২ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ভারতের গুজরাটে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। সেখানে চিপ সংযোজন, পরীক্ষা করা হবে।

মাইক্রন জানিয়েছে, এই বিনিয়োগে সহযোগিতা করছে গুজরাট সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার। এর ফলে মোট বিনিয়োগ গিয়ে ঠেকবে ২৭৫ কোটি মার্কিন ডলারে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ আসবে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে। ২০ শতাংশ আসবে গুজরাট সরকার থেকে। আর বাকি অর্থ দেবে তারা।

বিবিসি ও রয়টার্স অবলম্বনে রাকিব হাসান