ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শাহপরীর দ্বীপের উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের পথে স্থানীয় মানুষজন। রাত আটটার দিকে টেকনাফে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বিশেষ প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সবচেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে আসছে মোখা। অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় আজ রোববার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে কক্সবাজার ও উত্তর মিয়ানমার উপকূলে মূল আঘাত হানতে পারে। গতকাল শনিবার রাতে আবহাওয়ার সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, মোখার অগ্রভাগ গত রাতেই উপকূল স্পর্শ করার কথা। এর আগে সন্ধ্যা থেকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজারের টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন এবং চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি শুরু হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তর মোখার কারণে গতকাল কক্সবাজার এবং এর আশপাশের দ্বীপ ও চরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করেছে। উপকূলবর্তী আরও ১১টি জেলা এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরে জারি করা হয়েছে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত।

মোখার কারণে তিনটি বিপদের কথা বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর—বাতাসের তীব্র গতি, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিধস। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রে বাতাসের গতি উঠছে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এ কারণে এটিকে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বলা হচ্ছে। এই গতির কারণে কাঁচা ঘর ও ঝুপড়ি উড়ে যেতে পারে। গাছপালা উপড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মোখার কারণে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতা এবং ১০টি জেলায় ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। পাঁচ জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের আশঙ্কাও আছে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় গতকাল দিনভর সেন্ট মার্টিন দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। রাতেও অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, দেশের ১৩ জেলায় ৬ হাজার ৯৮৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।

এদিকে বাংলাদেশের দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট নিড অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি প্রভাব বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে গত শুক্রবার বলা হয়েছে, মোখার কারণে ঘণ্টায় ৯৩ কিলোমিটার বা তার বেশি গতিতে বাতাস বয়ে যেতে পারে ৪টি জেলার ২০টি উপজেলার ওপর দিয়ে। এতে ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ, যার মধ্যে প্রায় ২৮ লাখ নারী, ৭ লাখ ৫৮ হাজার শিশু (৪ বছরের কম বয়সী) এবং ৭৪ হাজার ৬৭৩ জন প্রতিবন্ধী। নারীদের মধ্যে ৭৪ হাজারের বেশি সন্তানসম্ভবা। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় ৭ লাখ ৬৩ হাজারের কিছু বেশি কাঁচা ও ঝুপড়ি রয়েছে। এসব ঘর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ঘূর্ণিঝড়কে ঘিরে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, কক্সবাজার ও উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার দ্বীপ ও চরের মানুষ, পাহাড়ি এলাকায় কাঁচা ও ঝুপড়ি ঘরের বাসিন্দা এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে গতকাল ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির বাস্তবায়ন বোর্ডের জরুরি সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। তিনি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে বলেন, গত শুক্রবার রাত থেকেই কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় বিপদাপন্ন জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া শুরু হয়। সবচেয়ে বিপদের সম্মুখীন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অবস্থানরত প্রায়

সাড়ে আট হাজার মানুষকে সর্বোচ্চ জলোচ্ছ্বাস ও ‘সুপার সাইক্লোন’ মোকাবিলায় সক্ষম ৩৭টি অবকাঠামোতে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেহেতু রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখ, সেহেতু তাদের সরিয়ে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নেই। রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) নেতৃত্বে সাড়ে চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। তাঁরা পাহাড়ে থাকেন। তাই জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা নেই। কিন্তু বৃষ্টিপাতের কারণে ভূমিধস হতে পারে। এটা মাথায় রেখে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।

মোখার সর্বশেষ অবস্থা
মোখার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে গতকাল রাত নয়টায় দেওয়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ছিল ২০০ কিলোমিটার। উল্লেখ্য, এর আগে ২০০৭ সালের নভেম্বরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২৩ কিলোমিটার। সিডরের পর বাংলাদেশে আঘাত হানা কোনো ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ মোখার মতো ছিল না বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টি গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৬০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান গতকাল রাত আটটায় প্ বলেন, ‘মোখার গতি (এগোনোর) শুক্রবার পর্যন্ত ৮ কিলোমিটারের মতো ছিল। কিন্তু আজ (শনিবার) থেকে এর গতি বেড়ে গেছে। এখন এটি প্রায় ২০ কিলোমিটার গতিতে এগোচ্ছে।’

কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি রাখার পাশাপাশি বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা জেলা এবং কাছের দ্বীপ ও চরগুলো ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের আওতায় রাখা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের মানে হলো বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরের ওপর বা কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। আর ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের মানে হলো, বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আর মোংলা সমুদ্রবন্দরকে দেখাতে বলা হয়েছে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত।

ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং এর কাছাকাছি দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং এদের কাছাকাছি দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বৃষ্টি হতে পারে। অতিভারী বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে।

২০১৯ সাল থেকে যত ঘূর্ণিঝড়
বাংলাদেশে ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফণী, আম্পান, ইয়াস ও সিত্রাং।

সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আঘাত হেনেছিল গত বছরের ২৪ অক্টোবর। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে বরিশাল বিভাগসহ চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জের বিস্তীর্ণ ফসলের খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মূল আঘাত হেনেছিল ভারতের ওডিশায়। ২০২১ সালের ২৬ মের এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশেও। ইয়াসের প্রভাবে বাংলাদেশের ১৫টি জেলার ৭৭টি উপজেলা ও ১৩টি পৌরসভায় ক্ষয়ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয় ৭ জনের।

২০২০ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রায় ২৮ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালায়। এতে দেশের ছয় জেলায় ২১ জন মারা যান। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। আক্রান্ত হয় বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর ২০ লাখ মানুষ। ওই বছরের মে মাসে আঘাত হেনেছিল ফণী। ফণীর প্রভাবে ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে এবং বরগুনায় দুজনসহ মোট পাঁচজন নিহত হন।

দেশের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। এতে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এরপর ওই এলাকায় আর বড় ধরনের কোনো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানেনি। ২০০৮ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস মূলত আঘাত হানে মিয়ানমার উপকূলে। তবে এতে কক্সবাজার উপকূলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মা-বাবা, ভাই-বোনকে হারান জোহরা খাতুন। তখন তাঁর বয়স ছিল ১০ বছর। থাকতেন কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার খুদিয়ারটেক এলাকায়। এখন বসবাস করেন কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক এলাকায়। গতকাল দুপুর ১২টায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘এখন আর কাউকে হারাতে চাই না।’