বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ তরুণীর বিয়ে হয়েছে তাঁদের শৈশবে | ছবি: ইউনিসেফ |
পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। দেশটিতে ৫১ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছিল তাঁদের শৈশবে।
বুধবার জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের নতুন এক বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তথ্যের উৎস হিসেবে ২০১৯ সালের বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৪৫ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে এবং ১ কোটি ৩ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাঁদের বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘শিশুদের বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বিস্ময়কর। লাখ লাখ মেয়ের শৈশব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মেয়েরা যাতে স্কুলে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে এবং তারা যাতে বেড়ে উঠতে পারে, সে সুযোগ দিতে আমাদের জরুরি ও সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।’
তবে গত এক দশকে বাল্যবিবাহ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এ হার কমে আসায় বড় ভূমিকা রাখছে দক্ষিণ এশিয়া। অগ্রগতি সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো প্রতি চার তরুণীর মধ্যে একজনের বিয়ে হচ্ছে তাঁর ১৮তম জন্মদিনের আগেই। এই অঞ্চলে বর্তমানে যে গতিতে বাল্যবিবাহ কমছে, তাতে সেখানে এ ধরনের বিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হতে প্রায় ৫৫ বছর লাগতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বে এখন যত বাল্যবধূ রয়েছে, তাদের ৪৫ শতাংশই এই অঞ্চলের। যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভারত এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা সত্ত্বেও এখনো বিশ্বের মোট বাল্যবধূর এক-তৃতীয়াংশই এ দেশের।
বাল্যবধূর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সাব-সাহারান আফ্রিকার অবস্থান দ্বিতীয় (২০ শতাংশ)। এই অঞ্চলে বর্তমানে যে গতিতে এ ধরনের বিয়ের হার কমছে, সেই গতিতে চলতে থাকলে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করতে ২০০ বছরের বেশি সময় লাগবে।
লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলও পিছিয়ে পড়ছে। সেখানে বর্তমানে যে হারে বাল্যবিবাহ হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে অঞ্চলভেদে বাল্যবিবাহের দিক থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চলে পরিণত হবে। ক্রমাগত অগ্রগতির পর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়াতেও অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত সর্বশেষ বৈশ্বিক হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে জীবিত প্রায় ৬৪ কোটি মেয়ে ও নারীর বিয়ে হয়েছে তাঁদের ছোটবেলায়। অথবা বলা যায়, প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের ছোটবেলায়। পাঁচ বছর আগে এ বিষয়ে সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যাওয়া তরুণীর সংখ্যা ২১ শতাংশ। এবার তা ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এই অগ্রগতি সত্ত্বেও ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা পূরণের জন্য বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহ কমানোর গতি ২০ গুণ বাড়াতে হবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
আজ বুধবার প্রকাশিত ইউনিসেফের নতুন বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত এক দশকে বাল্যবিবাহ ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী হওয়া সত্ত্বেও সংঘাত, জলবায়ুজনিত অভিঘাত, কোভিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাবসহ একাধিক সংকট এ ক্ষেত্রে কষ্টার্জিত অর্জন ভেস্তে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল এ বিষয়ে বলেন, একের পর এক সংকটে বিশ্ব জর্জরিত, যা ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের আশা ও স্বপ্নকে চুরমার করে দিচ্ছে, বিশেষ করে মেয়েদের, যাদের বিয়ের কনে হিসেবে নয়; বরং শিক্ষার্থী হিসেবে থাকা উচিত।
যেসব মেয়ের শৈশবে বিয়ে হয়, তাদের তাৎক্ষণিক ও জীবনভর এর পরিণতি ভোগ করতে হয়। তাদের স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। তারা অল্প বয়সে গর্ভধারণের বাড়তি ঝুঁকির মুখে পড়ে, ফলস্বরূপ যা শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের জটিলতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। বাল্যবিবাহের এই প্রচলন মেয়েদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব থেকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং তাদের নিজেদের কমিউনিটিতে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত রাখতে পারে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর চলমান প্রভাবগুলোর কারণে গত এক দশকে বাল্যবিবাহের অবসান ঘটাতে মূল্যবান অর্জনগুলোও হুমকির সম্মুখীন বা এমনকি তা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, মহামারি ইতিমধ্যে বাল্যবিবাহ বন্ধের সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে দিয়েছে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি, বাল্যবিবাহ বন্ধে অগ্রগতি সম্ভব। তবে এ জন্য বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়ে ও পরিবারগুলোর জোরালো সমর্থন প্রয়োজন। মেয়েদের স্কুলে টিকিয়ে রাখার বিষয়ে এবং তাদের অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।’