ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমাপনী দিনের অধিবেশনে বক্তব্য দেন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে এক হতে হবে। এ জন্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা থাকা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের জন্য স্থিতিশীল অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যৌথভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পরস্পরের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
রাজধানীর একটি হোটেলে আজ শনিবার ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের (আইওসি) সমাপনী দিনের প্রথম দুটি অধিবেশনে এমন অভিমত তুলে ধরেন সম্মেলনে অংশ নেওয়া কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা। ষষ্ঠবারের মতো এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রাণবন্ত ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি ও অংশীদারত্ব’।
বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভারতের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগিতায় দুই দিনের এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
সম্মেলনে অংশ নেয় ভারত মহাসাগর রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওরা), অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) এবং বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো–অপারেশনের (বিমসটেক) কয়েকটি সদস্যদেশ।
সমাপনী দিনের প্রথম দুটি অধিবেশনে প্রতিনিধিরা সমুদ্র ব্যবহার করে অবৈধ কর্মকাণ্ড ও মানব পাচার ঠেকাতে সমন্বিতভাবে লড়াই করার ওপর জোর দেন। এ ছাড়া তাঁরা পর্যটন ও প্লাস্টিকের কারণে বিপদে থাকা সাগর, সাগরের প্রাণী ও সম্পদ রক্ষা করতেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথাও বলেন।
সকালে প্রথম অধিবেশনে বক্তব্য দেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মন্ত্রী মালিকি বিন ওসমান। তিনি বলেন, করোনা মহামারি পরস্পরের পাশে থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ানোর জন্য আর্ন্তজাতিক যে চুক্তি রয়েছে, তা বাস্তবায়নে দেশগুলোকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। এ অঞ্চলের রাজনীতিতে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের অবস্থান জটিল উল্লেখ করে সমস্যার সমাধানের জন্য সংলাপ প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
শ্রীলঙ্কার বন্দর, জাহাজ ও বিমান চলাচলবিষয়ক মন্ত্রী নিমল সিরিপালা ডি সিলভা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কিছু দেশের প্রাথমিক নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেশগুলোর মধ্যে ভাগ করে নিতে হবে। সমুদ্র ঘিরে বিশাল অর্থনীতির সুবিধা নিতে নিজেদের মধ্যে সংযোগ বাড়াতে হবে।
সম্মেলনে অংশ নেওয়া মাদাগাস্কারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জোসোয়া রাকোতোয়ারিজায়োনাওয়ের মতে, হারিকেন, সাইক্লোন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলো ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, সেদিকেও নজর দিতে হবে।
প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সুরেশ প্রভু।
দ্বিতীয় অধিবেশনে দ্বীপরাষ্ট্র সেশেলসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চার্লস ই ফনসেকা বলেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে ঐক্যবদ্ধ একটি ফ্রন্ট দরকার। এই অঞ্চলকে মানব পাচারের জন্য বড় লক্ষ্যে পরিণত করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়াই করতে হবে।
ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তান্ডি দর্জি বক্তব্যের শুরুতে জানান, বাংলাদেশে আসার অনুভূতি তাঁর কাছে ঘরে আসার মতো। তিনি বাংলাদেশে মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে সাত বছর পড়াশোনা করেছেন। তিনি বলেন, বিশ্বের ৬৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলের। বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বড় অংশ আসে এ অঞ্চল থেকে। এই অঞ্চলের দেশগুলোকে একে অপরের সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও রাজনীতিকে সম্মান করে একে অপরের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
অধিবেশনে অংশ নিয়ে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারায়ণ প্রকাশ সাউদ বলেন, এক–তৃতীয়াংশ বৈশ্বিক বাণিজ্য হয় ভারত মহাসাগর অঞ্চল দিয়ে। তাই শুধু বৈচিত্র্য নয়, বাণিজ্য প্রসারে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। পর্যটকের কারণে সাগর প্লাস্টিকের ঝুঁকিতে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় দূষণ ও প্লাস্টিক থেকে সাগরকে বাঁচাতে হবে।
লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ বদর বিন হামাদ বিন হামুদ আলবুসাইদি বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলে শান্তি আসবে। কোনো দেশের নৌবাহিনী একা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা দিতে পারবে না, তাই এক হওয়া জরুরি।
ওমানের মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, বিশ্বের ৪০ শতাংশ জ্বালানি তাঁর দেশ থেকে আসে, সে ক্ষেত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অব্যাহত জ্বালানির সুবিধা পায়। অন্য দেশগুলোর জন্য ওমান জ্বালানি কীভাবে নিশ্চিত করতে পারে? জবাবে তিনি বলেন, তাঁর দেশ প্রতিবেশী ও অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে।
ভিডিও বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান বলেন, ভারত মহাসাগর অঞ্চল ঘিরে ২৭০ কোটি মানুষের বসবাস। এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি, অনিয়ন্ত্রিত মাছ আরোহণ, মানব পাচার রোধ করে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সহযোগিতা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সমুদ্র অঞ্চল ঘিরে কাজ করতে বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাকে অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর বলেন, দূরত্ব দিয়ে নয়, সহজে কোথায় পৌঁছানো যায়, সেটার ওপর ভিত্তি করে এখন প্রতিবেশী বিবেচনা করতে হবে। কারণ, প্রতিবেশী আছে, কিন্তু প্রতিবেশীর কাছে পৌঁছানো না গেলে তা কোনো কাজে লাগবে না। সত্যিকারভাবে এখন এক হওয়া দরকার।