এই ট্রলারটি থেকে অর্ধগলিত ১০ জেলের লাশ উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক উপকূলে | ফাইল ছবি |
প্রতিনিধি কক্সবাজার: কক্সবাজারে ডুবন্ত ট্রলারে অর্ধগলিত ১০ জনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি (ট্রলারের মাঝি) আবু তৈয়ূব ও ফজল কাদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ঘটনাটি তাঁদের চোখের সামনে ঘটেছে, তবে তাঁরা জড়িত ছিলেন না। গতকাল রোববার সন্ধ্যা ও রাতে দুই মাঝির জবানবন্দি রেকর্ড করেন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যা।
ফজল ও তৈয়ূবের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কুদুকখালী গ্রামে। গত মঙ্গলবার রাতে বাঁশখালী থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাবের একটি দল। এরপর কক্সবাজার মডেল থানাল পুলিশ ফজল ও তৈয়ূবকে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল দুপুরে তাঁদের আদালতে হাজির করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে আবু তৈয়ূব বলেছেন, তিনি আব্বাস কোম্পানির একটি ট্রলারের মাঝি ছিলেন। গভীর সাগরে তাঁরা ইলিশ মাছ ধরেন। ১১ রোজার দিন ট্রলারে ১৮ জন জেলে নিয়ে তৈয়ূব বাঁশখালী থেকে সাগরে রওনা দেন। সাত থেকে আট ঘণ্টা চালানোর পর ট্রলারটি মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলের মাঝামাঝি ৮ বিআর লাইন নামক স্থানে পৌঁছায়। তিন দিন পর ওই এলাকায় দেখা হয় ফজল (ফজল কাদের) মাঝির ট্রলারের। ১৭ রোজার দিন (৯ এপ্রিল) ভোর পাঁচটার দিকে তাঁরা সমুদ্রে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। প্রথমে তাঁরা ধারণা করেন, নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ চলছে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ফজল মাঝি জানান, খুটা জাইল্যাদের (ছোট মাছ ধরার জেলে) একটা ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। খুটা জাইল্যাদের ট্রলারটি ফ্ল্যাগ (নিশানা) তুলে পূর্ব দিকে চলে গেছে।
সমুদ্রে কোনো ট্রলারে বাঁশের মাথায় কাপড় বেঁধে ওড়ালে বিপৎসংকেত হিসেবে ধরে নেন জেলেরা। তৈয়ূবের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, খুটা জাইল্যাদের ট্রলারে কী হয়েছে, তা জানার জন্য তৈয়ূব ও ফজল মাঝির ট্রলার দুটি পূর্ব দিকে যেতে থাকে। কাছাকাছি গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, খুটা জাইল্যাদের পাঁচটি ট্রলার আরেকটি ট্রলারকে ঘিরে রেখে ট্রলারটির লোকজনকে লাঠি দিয়ে মারধর করছে। দূর থেকে মারপিটের এই দৃশ্য দেখতে থাকেন আরও কিছু জেলে।
আবু তৈয়ূব বলেন, হঠাৎ দেখতে পান, একজন লোক টাঙ্কিতে (প্লাস্টিক গ্যালন) ভেসে তাঁর ট্রলারের কাছে আসছেন। লোকটিকে তাঁরা ট্রলারে তুলে নেন। লোকটির বয়স আনুমানিক ৫০ বছর, মুখে সাদা দাঁড়ি। লোকটি ট্রলারে উঠে তাঁকে জানান, ডাকাতেরা তাঁকে মাছ ধরার কথা বলে সাগরে নিয়ে এসেছে। লোকটি বারবার তাঁকে বাঁচানোর জন্য বলছিলেন। চার থেকে পাঁচ মিনিট পর খুটা জাইল্যাদের একটি ট্রলার এসে তাঁর (তৈয়ূব) ট্রলারে আশ্রয় নেওয়া লোকটিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং আশ্রয় দেওয়ার কারণে তাঁকে গালমন্দ করে।
জবানবন্দিতে তৈয়ূব বলেন, কিছুক্ষণ পর তিনি দেখতে পান, খুটা জাইল্যারা ডাকাত বলে ঘিরে রাখা ট্রলারের লোকগুলোকে বাঁশ, বরফ ভাঙার মুগুর ও লাঠি দিয়ে বেদম পিটুনি দিচ্ছেন। মারের চোটে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। সেটা দূর থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছিল। ভয়াবহতা দেখে তৈয়ূব ও ফজল মাঝি তাঁদের ট্রলার নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পশ্চিম দিকে চলে যান। ২৫ রোজা পর্যন্ত সাগরে ছিলেন তৈয়ূব। এরপর ট্রলার নিয়ে বাঁশখালীতে পৌঁছে লোকজনকে ঘটনার কথা খুলে বলেন। পৃথক জবানবন্দিতে ফজল কাদেরও একই রকম জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত ২৩ এপ্রিল বিকেলে শহরের নাজিরারটেক উপকূলে ডুবন্ত একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। ২৫ এপ্রিল কক্সবাজার সদর মডেল থানায় এজাহারনামীয় ৪ জন (মহেশখালীর মাতারবাড়ীর বাইট্যা কামাল, করিম সিকদার, আনোয়ার হোসেন ও বাবুল মাঝি) এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে মামলা করেন ডুবন্ত ট্রলারের মালিক ও মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের বাসিন্দা নিহত সামশুল আলমের স্ত্রী রোকিয়া আকতার।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিদের ৪টি ট্রলারের ৫০ থেকে ৬০ জন লোক মিলে সামশুলের ট্রলারটি জিম্মি করে পরবর্তী সময়ে সামশুলসহ অন্যদের গলায় রশি পেঁচিয়ে, হাত–পা রশি ও জাল দিয়ে বেঁধে মারধর করে মাছ রাখার হিমাগারে ভেতর আটকে রাখেন এবং ওপর থেকে ঢাকনায় পেরেক মেরে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারের তলা ফুটো করে দেন। এতে সেটি ডুবে যায়। সামশুলের সঙ্গে এজাহারনামীয় চার আসামির পূর্বশত্রুতা ছিল।
মামলা করার দিনই মাতারবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বাইট্যা কামাল ও করিম সিকদারকে। বাইট্যা কামাল মামলার ১ নম্বর এবং করিম সিকদার ৪ নম্বর আসামি। বাইট্যা কামাল ও করিম সিকদার পুলিশের কাছে পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। মামলার গ্রেপ্তার অপর আসামি গিয়াস উদ্দিন মুনিরকে গতকাল তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে তাঁকে বদরখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই আসামি ফজল ও তৈয়ূবের তিন দিনের রিমান্ড শেষ হলে গতকাল আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কী বলেছেন, তিনি জানেন না।
ওসি আরও বলেন, পাঁচ দিনের রিমান্ডে আনা অপর দুই আসামি বাইট্যা কামাল ও করিম সিকদারকে আজ সোমবার দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদেরও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া কথা। এ মামলার এজাহারনামীয় অপর দুই আসামি আনোয়ার কামাল ও বাবুল মাঝির বাড়ি মহেশখালীতে। ঘটনার পর থেকে দুজন আত্মগোপনে রয়েছেন।