বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে যায় প্রায় পাঁচ হাজার দোকান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গবাজারের কাঠের মার্কেটের পুড়ে যাওয়া দোকানের স্মৃতিচিহ্ন বলতে শুধু কয়লা আর ছাই। ঈদ উপলক্ষে এই ব্যবসায়ীদের অনেকে ব্যাংক, সমিতি ও আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় লগ্নি করেছিলেন। তাঁদের দাবি, সব হারিয়ে এখন তাঁদের কাঁধে ঋণের বোঝা। ঋণের এ বোঝা কীভাবে কমাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঋণগ্রস্ত বেশির ভাগ ব্যবসায়ী।
গতকাল মঙ্গলবার ভোরে অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের বড় শঙ্কা—এখন নতুন করে ব্যবসা শুরুর জন্য এই জায়গা ফিরে পাবেন কি না। অনেকের ধারণা, পুড়ে যাওয়া জায়গায় তাঁদের আর বসতে দেওয়া হবে না। তবে নিঃস্ব হয়েও নতুন করে আবার ব্যবসায় ফিরতে চান তাঁরা। সে জন্য সরকারের সহায়তা চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বঙ্গবাজারে ৩৮ বছর ধরে ব্যবসা করছেন উল্লেখ করে এন এম সিল্ক হাউসের মালিক মো. নুরুন্নবী বলেন, ‘আমার তিনটি দোকানে সাড়ে চার কোটি টাকার মালামাল ছিল। ব্যাংকের ঋণ ছিল সাত লাখ টাকা। ঈদ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন থেকে ৮৫ লাখ টাকা ধার করে দোকানে মালামাল তুলেছিলাম। যাঁদের কাছ থেকে ধার নিয়েছি, তারা হয়তো এক-দুই মাস ধৈর্য ধরবেন। এরপর কেউ মানতে চাইবেন না, টাকা ফেরত চাইবেন। কী করে এ টাকা ফেরত দেব?’
সরকারি সাহায্য ছাড়া টিকে থাকার আর কোনো উপায় নেই বলে জানান বাচ্চাদের পোশাকের দোকান ইয়াসিন কালেকশনের মালিক মো. জসিম। তিনি বলেন, ‘দোকানে মালামাল ছিল ২৫–৩০ লাখ টাকার। সাত লাখ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় খাটিয়েছি। পুড়ে যাওয়ার আগে দোকানে সাড়ে তিন লাখ টাকা নগদ ছিল। নগদ সেই টাকাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। এ অবস্থায় ব্যাংকের টাকা কীভাবে ফেরত দেব জানি না। তাই সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছি।’
বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, একেকটি দোকানে গড়ে তিন থেকে পাঁচজন কর্মচারী কাজ করতেন। এসব কর্মচারীর পরিবারও দোকানগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন মালিক যেখানে নিঃস্ব, সেখানে কর্মচারীদের দেখবে কে। বিপণিবিতানটির ব্যবসায়ীদের অনেকের আবার ছোটখাটো পোশাক কারখানা রয়েছে। অনেকে চুক্তিতে এসব কারখানার সঙ্গে কাজ করেন। বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানও এখন বিপদে পড়েছে।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের ভাই ভাই ফ্যাশনের মালিক আজহার উদ্দিন বলেন, ‘আমি এই বাজারে অন্তত পাঁচটি দোকানে নিয়মিত কাপড় সরবরাহ করতাম। এর মধ্যে সোমবার এসব দোকানের মালিকদের পক্ষ থেকে আমাকে ২০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই দিন আমি আসতে না পারায় মঙ্গলবার আসব বলে তাঁদের জানিয়েছিলাম। তার আগেই সব দোকান পুড়ে ছাই। এখন আমিও ঝুঁকির মধ্যে পড়লাম।’
আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের সুমাইয়া ক্লথ স্টোরের মালিক মো. সবুজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার দোকানের ২০ লাখ টাকার কাপড় পুড়ে গেছে। তবে আমার কোনো ব্যাংকঋণ নেই। তাই ঋণের চাপ নেই। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসায়ী ঋণের দায়ে জর্জরিত।’
পাটোয়ারী ফ্যাশন নামের ছেলেদের পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সুমন পাটোয়ারী বলেন, আমার দুটি দোকানে ৫০ লাখ টাকার মাল ছিল। ঈদ সামনে রেখে ব্যবসার এটাই ছিল ভরা মৌসুম। মালামালের বাইরে গত কয়েক দিনের বেচাকেনা বাবদ নগদ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা দোকানে ছিল, সেই টাকাও পুড়ে গেছে।
শুধু যে ব্যবসায়ীরা পথে বসেছেন তা–ই নয়। এসব দোকানের সঙ্গে জড়িত কর্মচারীদের পরিবারও এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বঙ্গবাজারে শুভ ফ্যাশনের মোট ছয়টি দোকান ছিল। নিয়মিত–অনিয়মিত মিলে এসব দোকানে ৩০ থেকে ৩৫ জন কর্মী কাজ করতেন। তাঁদের একজন মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিই আমার ও আমার পরিবারের রুটিরুজির উৎস। আগুনে সব দোকানের মালামাল পুড়ে গেছে। যতটা জানি, মালিকের ব্যাংকঋণও ছিল। এখন মালিক ব্যবসায় ফিরতে না পারলে আমাদেরও সংসার চলবে না।’
ব্যবসায়ীদের এ ক্ষতি থেকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে থোক বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এখন সরকারের উচিত, দ্রুত থোক বরাদ্দ দিয়ে এসব ব্যবসায়ীকে পুনর্বাসিত করা। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের ভয় হচ্ছে, এই জায়গায় তাঁরা আর ফিরতে পারবেন না। এই জায়গায় ব্যবসায় ফিরতে না পারলে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
তবে বঙ্গবাজারের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ভেতর চারটি মার্কেট ছিল। এগুলো হলো বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট। এসব মার্কেটে প্রায় তিন হাজার দোকান ছিল। আগুনে সব দোকানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বঙ্গবাজারের পার্শ্ববর্তী বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট–সংলগ্ন এলাকারও বেশ কিছু দোকানপাট পুড়েছে। এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান জানান, আগুনের ঘটনায় প্রায় পাঁচ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।