ঈদ সামনে রেখে কাপড়ের দোকান দিয়েছেন শিক্ষার্থী শফি আলম। সেখানে পোশাক পছন্দ করছেন শিক্ষার্থীরা। গত সোমবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: দোকান নয়, খোলা জায়গা। লম্বা একটি টেবিলে হরেক রঙের পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট ও শাড়ি রাখা। এর সামনে ও পাশে মানুষের জটলা। পাঞ্জাবি, শার্ট নিয়ে দেখছেন অনেকে। টেবিলের অন্য পাশে কেউ পাঞ্জাবি গোছাচ্ছেন, কেউ টাকা গুনছেন। কেউবা দর–কষাকষির উত্তর দিচ্ছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবন-২–এর সামনে গত সোমবার বিকেলের দৃশ্য এটি। একটু সামনে গিয়ে জানা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শফি আলম ঈদ উপলক্ষে এই দোকান দিয়েছেন। সেখানেই মানুষের ভিড়।
শফি আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর বাড়ি কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপারে ভারতের সীমান্তঘেঁষা পাখিওড়া গ্রামে।
শফি আলম এবার দ্বিতীয়বারের মতো ঈদ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দোকান বসিয়েছেন। এই দোকান বসানোর পেছনে তাঁর অনেক দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। বাবা ময়নাল হক কৃষক। এখন বয়সের ভারে কাজ করতে পারেন না। পাঁচ ভাইবোনের ভাইদের মধ্যে তিনি ছোট। ভাইয়েরা বিয়ে করে আলাদা থাকছেন। তাঁদের সংসারেও টানাপোড়েন আছে।
শফির সঙ্গে কথা হয় তাঁর দোকানে। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বাড়ি থেকে খুব বেশি টাকা আনতে পারতেন না। রাজশাহীতে আসার পর নিজে চলতে টিউশনি বেছে নেন। ভালোই চলছিল। তবে বাদ সাধে ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে তিনিও বিবাহিত। বাসা নিয়ে রাজশাহী শহরে থাকেন। টিউশনি বন্ধ হয়ে যায়। তখন রাজশাহীতে আমের মৌসুম চলছিল। অর্থকষ্টে ভুগে শফি সিদ্ধান্ত নেন আমের ব্যবসা করবেন। তিনি অনলাইনে অর্ডার নিয়ে আম বিক্রি শুরু করেন। মৌসুম শেষ হওয়াতে আমের ব্যবসা শেষ হয়ে যায়। এবার তিনি স্ত্রীর নাম দিয়ে খোলেন ‘রেমি ফ্যাশন হাউজ’।
শফি আলম জানান, অনলাইনে শাড়ি, সালোয়ার–কামিজ, শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি পাঠাতে থাকেন। ভালো সাড়া পেয়ে যান তিনি। রাজশাহীতে অর্ডারগুলো তিনি হোম ডেলিভারি দেন। এই আয়েই তাঁর সংসার চলে। আর বাড়িতেও নিয়মিত অর্থ পাঠাচ্ছিলেন। পরে ২০২২ সালে রমজান মাসে তিনি ক্যাম্পাসে পাঞ্জাবি আর শাড়ির দোকান দেন। গত বছর তিনি প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার পোশাক বিক্রি করেন।
এবার নারীদের জন্য টাঙ্গাইলের শাড়ি, ছেলেদের জন্য প্যান্ট, শার্টসহ প্রায় ১৯ ধরনের পাঞ্জাবি নিয়ে ক্যাম্পাসে স্টল সাজিয়েছেন শফি আলম। তিনি বলেন, চাহিদা বেশি পাঞ্জাবির। ২২০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত দামের পোশাক রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এখানে আসেন। তাঁদের কথা চিন্তা করেই বিভিন্ন দামের পাঞ্জাবি রাখা হয়েছে।
শফি আলমের কাজে সহায়তা করছেন বেশ কয়েকজন। বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী তাঁকে এই কাজে সাহায্য করছেন। গত ২৬ মার্চ তাঁরা স্টল দিয়েছেন। ইতিমধ্যে ৫৫ হাজারের বেশি টাকার কাপড় বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে পাঞ্জাবিই বেশি বিক্রি করেছেন।
শফি আলমের দোকান থেকে পাঞ্জাবি কিনছিলেন বেশ কয়েকজন। এদের একজন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জহুরুল ইসলাম বলেন, এখানে তাঁদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী দোকান দিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে কিছু কেনাটা তাঁকে সমর্থন দেওয়া।
শফি আলম বলেন, সরকারি চাকরির পেছনে সবাই ছোটেন, হতাশায় ভোগেন। তিনিও হয়তো সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসবেন। কিন্তু সেটা একেবারে জানপ্রাণ দিয়ে নয়। সরকারি চাকরি হলে হবে, না হলে ব্যবসাকেই বেছে নেবেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এখন সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাফিজুর রহমান বলেন, নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সংকল্প শফির মধ্যে ছিল। অনেকেই এটা পারেন না, যা শফি পেরেছেন। বর্তমান তরুণ সমাজ যেখানে চাকরির পেছনে ছুটে চলেছেন অন্ধের মতো, শফি সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে চলেননি। তাঁর এই সাহস একসময় অন্য তরুণদের পাথেয় হবে।