রাজধানীর নিউমার্কেটের পাশে নিউ সুপার মার্কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ চলছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘ঈদের আগে এমনভাবে আগুন লাগবে, আর আমার সব শেষ হয়ে যাবে, তা কল্পনাও করিনি। বুঝতে পারিনি, আমাদের অবস্থা বঙ্গবাজারের দোকানিদের মতো হবে।’
রাজধানীর নিউমার্কেটের পাশে নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলছিলেন এ কথা। আগুনে পুড়েছে তাঁর দোকান আয়ান রয়েল গার্মেন্টস।
আজ শনিবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন পুরোপুরি নেভাতে আরও সময় লাগবে বলেছে তারা।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ ও নানাভাবে আহত হয়ে এ পর্যন্ত ৩২ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য রয়েছেন ৯ জন।
দোকানিদের মালামাল উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন।
ঈদের মাত্র সাত দিন বাকি থাকতেই আগুনে পুড়ল নিউ সুপার মার্কেট। ৪ এপ্রিল ভোরে রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে সব হারিয়ে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা এখন চৌকি পেতে পণ্য বিক্রি করছেন। চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়ানোর। এর ১১ দিন পর আবার নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
ব্যবসায়ীদের আহাজারি
ঈদের আগে নিউ সুপার মার্কেটের দোকানগুলো গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় দোকানগুলোয় ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। অনেক দোকান দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত দোকান খোলাও ছিল।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ী বলেছেন, রাত তিনটা থেকে চারটার মধ্যে দোকান বন্ধ করে বাসায় গিয়ে সাহ্রি খেয়ে নামাজ আদায় শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর মুঠোফোনে নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় আগুন লাগার খবর পান।
নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডস্থলে ধোঁয়ার কুণ্ডলী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন হুমায়ুন কবির। নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় তাঁর চারটি দোকান। দোকানে এক কোটি টাকার বেশি মালামাল ছিল বলে জানান তিনি। বললেন, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে আর ভেতরে যেতে সাহস পাননি। অসহায় হয়ে আগুনে মালামাল পুড়তে দেখেন।
ঈদের আগে দোকান পুড়ে যাওয়ার পর আবু রনি গার্মেন্টস দোকানের মালিক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সারা বছর আমাদের দোকানে কোনো বিক্রি সেভাবে হয় না। এই ঈদের আগে রমজান মাসে বিক্রি হয় বেশি। বেচাকেনা জমে উঠল। আশায় ছিলাম, করোনায় যা লোকসান, তা এবার পুষিয়ে নেব। কিন্তু গভীর রাতে বাড়ি ফেরার পর আগুনে পুড়ে গেছে আমার সব স্বপ্ন।’
আগুনে সব হারিয়ে কাঁদছেন দুই বন্ধু রাব্বি ও পলাশ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এক যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার বিভিন্ন দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন মো. রাব্বি ও মো. পলাশ নামের দুই বন্ধু। তাঁদের স্বপ্ন ছিল, একদিন নিউমার্কেট এলাকায় দোকানের মালিক হবেন। মাত্র চার মাস আগে আলহামদুলিল্লাহ গার্মেন্টস নাম দিয়ে একটি দোকান ভাড়া নেন রাব্বি ও পলাশ।
গতকাল দিবাগত রাত চারটার সময় দোকান বন্ধ করে বাসায় যান দুই বন্ধু। সাহ্রি শেষে ঘুমিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আগুনের খবর শোনেন। আগুনে নিজেদের হাতে গড়া দোকান পুড়তে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই বন্ধু।
রাব্বি বলেন, ‘গরিবের পোলা আমি। অনেক কষ্ট করে দুই বন্ধু মিলে দোকান দিয়েছি। কিন্তু আগুন আমাদের সবকিছু শেষ করে দিল। এখন ক্যামনে আমরা ঘুরে দাঁড়াব?’
রাব্বি ও পলাশ জানান, ঈদের আগে চার লাখ টাকার মালামাল কিনে দোকানে রেখেছিলেন।
পদচারী–সেতু ভাঙা নিয়ে ক্ষোভ
ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার ৪ নম্বর গেটের সামনের পদচারী–সেতু ব্যবহার করে ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ঢুকতে হয়। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ী বললেন, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সিটি করপোরেশনের লোকজন সাত দিন আগে পদচারী–সেতুটি ভাঙার উদ্যোগ নেয়। ঈদের আগে সেতুটি ভাঙতে নিষেধ করেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, ঈদের আগে এটি ভেঙে ফেলা হলে ক্রেতাদের অনেকের আসতে সমস্যা হবে।
আগুন থেকে বাঁচাতে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে মালপত্র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আগুনে চারটি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যবসায়ী মাহাবুব শেখ বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, ঈদের আগে এই ফুটওভার ব্রিজটি যেন ভেঙে না ফেলা হয়। কিন্তু আজ শুনছি, রাতে নাকি ফুটওভার ব্রিজটি ভাঙার কাজ শুরু করেছিল সিটি করপোরেশনের লোকজন।’
আরেক ব্যবসায়ী মাসুমও বলেন, ঈদের আগে কেন এই ফুটওভার ব্রিজটি ভাঙতে হবে।
ঝুঁকি নিয়ে মালপত্র বাঁচানোর চেষ্টা
সকাল সাড়ে ৬টার পর থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকার নিউ সুপার মার্কেট এলাকায় অবস্থান করে দেখা গেছে, নিচতলার দোকানিরা মালামাল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। ওই মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় সময়ের ব্যবধানে আগুন ছড়ায়। তবে দ্বিতীয় তলায় আগুনের পরিমাণ কম। দুই তলায় যাদের দোকান আছে, তারা ঝুঁকি নিয়ে দোকানের ভেতর ঢুকে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। দোকান থেকে মালামাল বের করে আনতে সব ধরনের সহযোগিতা করছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের ক্রেন ব্যবহার করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে মালামাল বের করে আনতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
এখনো ধোঁয়া
পৌনে ১২টার দিকেও মার্কেটের তৃতীয় তলা থেকে আগুনের ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে দেখা গেছে। পুরো নিউমার্কেটে এলাকার সব দোকান বন্ধ রয়েছে। তবে সব দোকানের সামনে অবস্থান করছেন উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। নিউ সুপার মার্কেটসংলগ্ন দক্ষিণের নিউমার্কেটের অনেক দোকান থেকে মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেছে।
ঈদের কয়েক দিন আগে ভয়াবহ আগুনে বদলে গেছে নিউমার্কেট এলাকার চিত্র। ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় আছেন, কখন আগুন পুরোপুরি নিভে যাবে।