বাঁশি তৈরিতে ব্যস্ত কারিগরেরা। বুধবার নওগাঁ সদর উপজেলার দেবীপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি নওগাঁ: কেউ নলখাগড়া বা নল কেটে মাপমতো টুকরা করছেন। কেউ আবার টুকরা করা নলখাগড়ায় রং করছেন। নলের টুকরাগুলোতে রঙিন জরি ও বেলুন লাগাতে ব্যস্ত অন্যরা। এভাবেই তৈরি করা হচ্ছে গ্রামবাংলার পরিচিত নলের বাঁশি। নলের এই বাঁশি সাধারণত শিশুদের কাছে ‘খেলনা বাঁশি’ হিসেবে পরিচিত।
বাঁশি তৈরির কর্মযজ্ঞ চলছে নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামে। সবুজে ঘেরা এ গ্রামের লোকজন প্রায় কয়েক যুগ ধরে নলখাগড়া দিয়ে খেলনা বাঁশি তৈরি করে আসছেন। গ্রামটি বর্তমানে পরিচিতি পেয়েছে খেলনা বাঁশির গ্রাম নামে। গ্রামটিতে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামের জনসংখ্যার অর্ধেকই বাঁশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। গ্রামের লোকজন সারা বছরই বাঁশি তৈরি করেন। তবে ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যেষ্ঠ মাসে তাঁদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কারণ, এ সময় আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামীণ মেলা বসে। এসব মেলায় বিক্রির জন্য ফেরিওয়ালা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দেবীপুরের কারিগরদের কাছ থেকে বাঁশি কিনে নিয়ে যান। তবে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে এবার রোজা পড়ায় গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে কম। ফলে বাঁশির চাহিদা কম। এবার বাঁশির ব্যবসা খারাপ চলছে বলে দাবি বাঁশির কারিগরদের।
দেবীপুর উত্তরপাড়ার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর নিজের কোনো আবাদি জমি নেই। একটি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নল কিনে ৮ হাজার বাঁশি তৈরি করেছেন তিনি। বেশি লাভের আশায় নিজেই মেলায় মেলায় গিয়ে বাঁশি বিক্রি করতে চান। কিন্তু এলাকা বা আশপাশের জেলাগুলাতে খুব বেশি মেলার খোঁজখবর পাচ্ছেন না। এখন পর্যন্ত ফেরি করে মাত্র ২ হাজারের মতো বাঁশি বিক্রি করতে পেরেছেন।
গতকাল বুধবার দেবীপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বারান্দা, আঙিনা ও বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় গাছের ছায়ায় কারিগরেরা বসে বাঁশি তৈরির কাজ করছেন। পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত। কেউ নলখাগড়া বা নলের গাছ কেটে বাঁশির বিভিন্ন ভাগ তৈরি করছেন। আবার কেউ সেই বাঁশিতে জরি ও বেলুন লাগাচ্ছেন।
ব্যস্ত সময় পার করছেন বাঁশির কারিগরেরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
গ্রামের যারা বাঁশি বানান, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথ হয়। তাঁদের ভাষ্য, ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে এই গ্রামে আলেক মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি বাঁশি তৈরির কাজ শুরু করেন। তাঁর দেখাদেখি পর্যায়ক্রমে পুরো গ্রামের মানুষ এ পেশায় জড়িয়ে পড়েন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখান থেকে প্রতি হাজার বাঁশি ২ থেকে ৫ হাজার টাকায় পাইকারি দামে কিনে নেন। এসব বাঁশিই আবার মেলায় গিয়ে প্রতিটি ৫ থেকে ১৫ টাকা করে বিক্রি হয়।
বাঁশির কারিগর সেই আলেক মণ্ডল এখন নেই। কিন্তু তাঁর ছেলে ৬০ বছর বয়সী আনিসুর রহমান বাবার পেশা আঁকড়ে ধরে এখনো জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। আনিসুর রহমান বলেন, তাঁর বাবা এ গ্রামে প্রথম বাঁশি তৈরির কাজ শুরু করেন। ছোটবেলা থেকে বাবা-মাকে বাঁশি বানানো দেখতে দেখতে তিনিও বাঁশি বানানো শিখেছেন। এখন তো গ্রামের প্রায় সব পরিবারেই কম-বেশি বাঁশি তৈরি হয়। বর্তমানে তিনি বাঁশি তৈরি না করলেও গ্রামের দরিদ্র মানুষ দিয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বাঁশি তৈরি করিয়ে নেন। তাঁর অধীনে প্রায় ১৫০ জন লোক কাজ করেন।
গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি তৈরি করছেন তাঁরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। গ্রামের শতাধিক পরিবার সারা বছর নলের বাঁশি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। গুটি কয়েক পরিবার নিজেদের জমিতে নল বা নলখাগড়ার চাষ করেন। আবার অনেক হতদরিদ্র পরিবার বিভিন্ন এনজিও এবং মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে নল কিনে বাঁশি তৈরি করেন। সারা বছর বাঁশি তৈরি হলেও চৈত্র সংক্রান্তি, বৈশাখী মেলা, দুই ঈদ ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে বসা গ্রামীণ মেলায় বাঁশি বিক্রি বেড়ে যায়। পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাসজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে বৈশাখী মেলা। এসব মেলায় বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দেবীপুর থেকে বাঁশি কিনে নেন।
বাঁশি তৈরির কাজ করছেন এক নারী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কারিগর আনিসুর রহমান বলেন, সারা বছর বাঁশি তৈরি হলেও বৈশাখী মেলা উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি বাঁশি বিক্রি হয়। কিন্তু এবার রোজার মধ্যে পয়লা বৈশাখ পড়ায় তেমন মেলা বসবে না। ফেরিওয়ালা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাঁশি চাহিদা দেখা যাচ্ছে না। গত বছর চৈত্র ও বৈশাখ মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকার বাঁশি বিক্রি করেছিলেন। এবার তো চৈত্র মাস চলে গেল, বৈশাখ পড়ছে; এখন পর্যন্ত মাত্র চার লাখ টাকার বাঁশি বিক্রি হয়েছে।
বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় মেহগনি গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি তৈরি করছিলেন নাসির উদ্দিন ও মৌসুমি বেগম দম্পতি। তাঁরা বলেন, বাঁশি তৈরি তাঁদের প্রধান পেশা। পরিবারের ছয় সদস্যের সবাই বাঁশি বানাতে পারেন। এবার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বিভিন্ন গ্রামীণ মেলা উপলক্ষে তাঁরা ২০ হাজার বাঁশি তৈরি করেছেন। এখন পর্যন্ত ৫ হাজার বাঁশি পাইকারি বিক্রি হয়েছে। এখনো প্রায় ৮ হাজার বাঁশির অর্ডার আছে।