কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নানা শ্রেণি–পেশার হাজারো মানুষ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বিশেষ প্রতিবেদক: হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হলেন সদ্য প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আগামীকাল শুক্রবার ঢাকার সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে।

গত মঙ্গলবার রাত ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি দীর্ঘদিন কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। বার্ধক্যজনিত সমস্যাও দেখা দিয়েছিল তাঁর।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ সকালে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় লেখক, অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ, উন্নয়ন ও অধিকারকর্মীরা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্ম ও জীবনের ওপর আলোকপাত করেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে একটি অস্থায়ী মঞ্চ বানানো হয়। তাঁর কফিনের পাশে ছিলেন স্ত্রী শিরীন হকসহ পরিবারের সদস্যরা। সেখানেই কাঠফাটা রোদ আর প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও কয়েক হাজার মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আদর্শ বাঙালি ছিলেন। দেশের চিকিৎসা বিষয়ে নতুন চিন্তার পথিকৃৎ তিনি। তাঁকে নিয়ে গর্ব করার অনেক বিষয় আছে।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দুটি ক্ষেত্রে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাজ উল্লেখযোগ্য। একটি স্বাস্থ্য, আরেকটি হলো শিক্ষা। আবার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি। তিনি অর্থনৈতিকভাবে নারীদের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, নানা প্রতিষ্ঠান জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কোনোটাই ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত নয়। কোনোটার মালিক তিনি নিজে নন। মালিক হচ্ছে সমাজ। এই যে সামাজিক মালিকানায় প্রতিষ্ঠান গড়া এ দেশে অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। এ জন্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন, অনুসরণীয় হয়ে রয়েছেন। মুক্তির সংগ্রাম যত অগ্রসর হবে, জাফরুল্লাহর স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন। আমাদের প্রজন্মের মানুষ তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। তিনি সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন। কিন্তু বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি সাধারণ মানুষের কাতারে চলে এলেন। এখান থেকেই নতুন প্রজন্ম শিক্ষা নিতে পারে।’

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানাজা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন অসাধারণ, সাহসী, দেশপ্রেমী, সৎ ও নির্ভীক মানুষ ছিলেন। তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কথা বলতে কখনো পিছপা হননি। এই রাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে জনগণের রাষ্ট্র, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র এবং সাধারণ মানুষের জন্য সমাজ নির্মাণের জন্য তাঁর সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন।’

শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ও অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক পারভীন হাসান, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, শিল্পী রফিকুন নবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নিজেরা করির খুশী কবির, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, গণফোরামের একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসীন ও সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, কবি আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় পার্টির মোস্তফা জামাল হায়দার, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অধ্যাপক সি আর আবরার, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ডা. রশিদ-ই মাহবুব, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া ও সদস্যসচিব নুরুল হকসহ অনেকে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে শামিল হয়েছিলেন রাজনীতিবিদেরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স), জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন  আখতার, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, আশা পরিবারের পক্ষে সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, কবি ও লেখক ফরহাদ মজহার, নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা ও উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার প্রমুখ।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সেগুলোর মধ্যে ছিল প্রশিকা, মহিলা পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, নারীপক্ষ, ব্যুরো বাংলাদেশ, এডাব, বাসদ (মার্ক্সবাদী), জাগপা, ১২ দলীয় জোট, জাতীয় দল, কোস্ট ফাউন্ডেশন, এনপিপি, গণসংস্কৃতি ফ্রন্ট, বিপ্লবী রিকশা শ্রমিক সংহতি, লেবার পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, যুব মৈত্রী, গণমুক্তি ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ, গণ সাহায্য সংস্থা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, ফ্রিডম ফাইটার কাউন্সিল, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ব্লাস্টসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন ও অনেক ব্যক্তি।

গার্ড অব অনার
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে গার্ড অব অনার দেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) হেদায়েতুল ইসলাম। এতে পুলিশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন আ. রহমান।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বেলা আড়াইটায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল পৌনে নয়টায় ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে এবং পৌনে ১০টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) তাঁর জানাজা হয়। এ ছাড়া বিকেল চারটায় ধানমণ্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আরেক দফা জানাজা হয়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জানাজায় অংশ নেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলামসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন অনেকে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

জানাজার আগে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছেলে বারিশ চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবার সারা জীবনের ইচ্ছা ছিল তাঁর দেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য দান করা হোক। সন্তান হিসেবে, পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা এই আশা পূরণ করতে চেষ্টা করেছিলাম। এ জন্য আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে দেহ দান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই শুনেছি, কেউ নেই যে আমার বাবার লাশে ছুরি লাগাতে পারবেন। সম্মান থেকেই এটি বলা হয়েছে। যখন সম্মান ও ভালোবাসা থেকে বলা হয়েছে কেউ হাত দিতে রাজি নন, তাই সেটি নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। তাই কালকে (শুক্রবার) সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে দাফন করব।’

বারিশ চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের পরেও তাঁর যুদ্ধ শেষ হয়নি। তাঁর যুদ্ধ তাঁর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত চলেছে। তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় ছিল দেশ, দেশের মানুষ ও মানুষের অধিকার। আর এ জন্য তিনি সারা জীবন লড়াই করেছেন। তিনি চেয়েছেন আমরা সবাই যেন এ জন্য লড়াই করি। শুধু লড়াই নয়, যেন আদায় করি।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামীকাল শুক্রবার বাদ জুমা সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মূল ফটকের বাঁ পাশে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দাফন করা হবে। তার আগে সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য মরদেহ দেখার ব্যবস্থা থাকবে।