সাভারে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান | ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ১৮ ঘন্টা পরেও প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান কোথায় আছেন, তা জানা যায়নি। বুধবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তাঁকে আটক বা গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আজ ভোররাত চারটার দিকে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের আমবাগান এলাকায় শামসুজ্জামানের বাসায় যান ১৪–১৫ জন ব্যক্তি। নিজেদের সিআইডি সদস্য পরিচয় দিয়ে শামসুজ্জামানের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তাঁর ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুটি মুঠোফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যান। পরে শামসুজ্জামানকে নিয়ে যান তাঁরা। এ সময় ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু মণ্ডলও ছিলেন।

শামসুজ্জামানের বিষয়ে জানতে সকালে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান এবং সিআইডির ঢাকা বিভাগের উপমহাপরিদর্শক মো. ইমাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরা কেউই শামসুজ্জামানকে আটক বা গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিছু বলেননি।

দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি জানা। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায়, সংক্ষুব্ধ হয়ে থানায় মামলা রুজু করে সেই অনুযায়ী পুলিশ কিন্তু ব্যবস্থা নিতেই পারে। আমি যতটুকু জানি, একটা মামলা রুজু হয়েছে।’ পরে জানা যায়, সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামের এক ব্যক্তি মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে তেজগাঁও থানায় শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেছেন। বাদির পরিচয়ে লেখা হয়েছে তিনি ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা। তাঁর ফেসবুক পেজে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি যুবলীগের ঢাকা মহনগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

গত ২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ভুল করে ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতিটি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর। বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।

ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক ছিলেন শামসুজ্জামান। এই ঘটনার জের ধরেই তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন গোলাম কিবরিয়া। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান বলেন, ‘আমার থানায় সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে আসামি গ্রেপ্তারের তথ্য আমার কাছে নেই।’

তবে শামসুজ্জামানকে যখন তুলে আনা হয়, সে সময় স্থানীয় একজন সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ভোর ৪টার দিকে তিনটি গাড়িতে প্রায় ১৪–১৫ জন ব্যক্তি শামসুজ্জামানের বাসার সামনে যান। তাঁদের মধ্যে সাত থেকে আটজন বাসায় ঢোকেন। একজন শামসুজ্জামানের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তাঁর ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুটি মুঠোফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যান। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর ওই ব্যক্তিরা শামসুজ্জামানকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যান।
 
প্রত্যক্ষদর্শী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বটতলার নুরজাহান হোটেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন, একজন নিরাপত্তাপ্রহরী এবং শামসুজ্জামানসহ তাঁকে আটককারীরা সাহ্‌রি খান।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ওই সাংবাদিক বলেন, সিআইডির সদস্য পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা ভোর পৌনে ৫টার দিকে শামসুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে আবার তাঁর বাসায় যান। দ্বিতীয়বার বাসায় যাওয়ার সময় আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু মণ্ডলকে দেখা যায়। দ্বিতীয়বার বাসায় এসে তাঁরা জব্দ করা মালামালের তালিকা করেন। শামসুজ্জামানকে জামাকাপড় নিতে বলেন। কক্ষের মধ্যে দাঁড় করিয়ে তাঁর ছবি তোলা হয়। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে আবার তাঁরা বের হয়ে যান। বাসা তল্লাশির সময় দুবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে সুদীপ্ত শাহিন বলেন, ‘রাত একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোর স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বলেন সিআইডি সাইবার ক্রাইমের একটি চৌকস দল ক্যাম্পাস হয়ে আমবাগান এলাকায় যাবেন। আমাকে তাদের সহযোগিতা করতে বলা হয়। এর ১০ মিনিট পর সিআইডির একজন পুলিশ সুপার আমাকে ফোন দেন। বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্টার উম্মে সালমার সমস্যা হয়েছে, আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলব। আসামি ধরার কোনো বিষয় নেই। পরে তাঁরা তিনটি গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান এলাকায় যান। শামসুজ্জামানকে আটক করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরে আমি ওই পুলিশ সুপারকে ফোন দিয়ে বলি আপনারা বললেন সহকারী রেজিস্টারের সঙ্গে কথা বলবেন, কিন্তু এখন শুনছি আপনারা অন্য কাউকে আটক করেছেন। পরে ওই পুলিশ সুপার আমাকে বলেন, শামসুজ্জামানকে আপনি নাও চিনতে পারেন তাই সহকারী রেজিস্টারের নাম বলেছিলাম।’

শামসুজ্জামান ক্যাম্পাস সংলগ্ন আমবাগানের যে বাসায় থাকেন, সেই বাড়ির মালিক ফেরদৌস আলম কবীর। তিনি সকালে বলেন, ‘রাত ৪টার ঠিক আগে আগে পাশের বাড়ির একজনকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকজন বাসায় এসে বলেন তারা সিআইডির লোক। তারা গেট খুলে দিতে বলেন, জানতে চান এখানে সাংবাদিক শামস থাকে কি না। এরপর তিনি গেট খুলে দেন। তারা শামসের ফ্ল্যাটের দরজা নক করতে বলেন। তিনি দরজা নক করে শামসকে ডেকে তোলেন।’

এরপর তারা শামসের মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়ে তাকেঁসহ বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা বলে যান, তারা শামসকে নিয়ে সাহরি খেতে বটতলায় যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর তারা আবার ফিরে আসেন। তখন তারা ৬-৭ জন ছিলেন। একজনের পরনে পুলিশের পোশাক ছিল। এরপর তারা শামসকে নিয়ে চলে যান।

শামসের বড় ভাই রবিউল ইসলাম পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালালে যে পুলিশ সদস্যরা প্রথমে তাঁদের রুখতে গিয়েছিলেন, সেখানে ছিলেন সে সময় গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। তখন জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন রবিউল।

ছেলেরা ছাত্র থাকাকালে স্বামী হারানো শামসের মা করিমন নেসা দুই ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। বড় ছেলে রবিউলের মৃত্যুর পর শামসুজ্জামানকে নিয়েই তাঁর জগত। আজ সকাল ১০টার দিকে ছেলেকে সিআইডি পরিচয়ে লোকজন ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর শুনে বুক চাপড়ে কান্না করেন তিনি। করিমন নেসা বলেন, ‘আমার ছেলে কি চুরি করেছে, নাকি ডাকাতি করেছে। আমার ছেলের কী অপরাধ? আমার ছেলেকে বললে ও নিজেই থানায় গিয়ে হাজির হতো। কেন এভাবে রাতে আমার ছেলেকে তুলে নেওয়া হল?’