বাজারদরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে মাংস বিক্রি করে সাড়া ফেলেছেন নজরুল ইসলাম। বুধবার বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কদমতলী তিনমাথা মোড়ে  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বগুড়া: বগুড়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে গরুর মাংসের দাম। রমজান মাসের শুরু থেকেই শহরের বাজারে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭০০-৭২০ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। গরুর মাংসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ও পাকিস্তানি মুরগির দাম। এত দাম দিয়ে মাংস কিনে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

শহরে যখন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মাংস কেনা অসাধ্য হয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই ক্রেতাদের সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে ৫৮০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করে সাড়া ফেলেছেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের কদমতলী সিএনজি স্ট্যান্ড তিনমাথা মোড়ের মাংস ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম ওরফে কালু কসাই (৬০)।

প্রায় এক বছর ধরে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করছেন তিনি।

কম দামে গরুর মাংস বিক্রির এ খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ‘কালু কসাই’ এখন ভাইরাল। নজরুল ইসলামের বাড়ি গাবতলীর নশিপুর গ্রামে।

কম দামে মাংস বিক্রির খবর ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে ক্রেতা নজরুলের দোকানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। সকাল থেকে অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরুর মাংস কিনছেন। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করছেন তিনি। শুক্রবার ছুটির দিনে ক্রেতাদের ভিড় বেশি থাকে। এদিন ৮ থেকে ১০টি গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করেন তিনি।

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে গাবতলীর কদমতলী তিনমাথা সিএনজি স্ট্যান্ড মোড়। বগুড়া-বাগবাড়ি সড়কে এই কদমতলী তিনমাথা মোড়েই নজরুল ইসলামের গোশত ঘর দোকান। বগুড়া শহরের চেয়ে দামে কম পেয়ে তাঁর দোকানে মাংস কেনার জন্য প্রতিদিন ভিড় করছেন ক্রেতারা।

গাবতলী, ধুনট—এমনকি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলা থেকেও সাতসকালে নজরুলের দোকানে মাংস কেনার জন্য ছুটছেন। ক্রেতারা আসছেন, দেখছেন আর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিদিনের মতো বুধবার সকালে নজরুলের দোকানে ছিল ক্রেতাদের ভিড়। এদিন পাঁচটি গরু জবাই করা হয়েছে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী দোকানের দুজন সহকারী মাংস কাটাকুটি করে ডিজিটাল পাল্লায় মেপে দিচ্ছেন। মাংসের দাম বুঝে নিচ্ছেন নজরুলের ছেলে কলেজছাত্র হোসাইন আল মাহমুদ।  

দোকানে মাংস কিনতে আসা গাবতলীর নিজগ্রামের কলেজশিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, এক কিলোমিটার অদূরেই বাগবাড়ি বাজার। সেখানে গরুর মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৮০ টাকায়। অথচ কদমতলী মোড়ে নজরুলের দোকানে প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকায়।

নিজগ্রামের চাকরিজীবী ফেরদৌস হোসেন বলেন, এক বছর ধরে নজরুলের দোকানে কম দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে। প্রথম দিকে ৫০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি হতো এখানে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পর ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়। কম দামে মাংস বিক্রির ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এর পর থেকে শহর থেকে লোকজন এখানে মাংস কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ইজারাদারদের চাপে এখন ৫৮০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করছেন তিনি।

নজরুল ইসলাম বলেন, দুই যুগ ধরে মাংস বিক্রির ব্যবসায় যুক্ত। আগে বাগবাড়ি বাজারে মাংসের দোকান ছিল তাঁর। কিন্তু গত বছর টোল আদায় নিয়ে ইজারাদারের সঙ্গে বিরোধ বাধে। একটি গরু জবাই করলে চার হাজার টাকা টোল দাবি করেন তাঁরা। বাধ্য হয়ে বাগবাড়ি বাজার থেকে ব্যবসা গুটিয়ে কদমতলী তিনমাথা মোড়ে এসে দোকান খুলে বসেছেন। এখানে প্রতিদিন চার-পাঁচটি গরুর মাংস বিক্রি হয়। শুক্রবার ক্রেতার ভিড় বেশি থাকে। এদিন ৮-১০টি গরুর মাংস বিক্রি হয়। প্রথম দিকে এলাকার ক্রেতারাই এখানে মাংস কিনতেন। এখন বেশির ভাগ ক্রেতা আসেন বিভিন্ন এলাকা থেকে। তিনি তরণীর হাট, মহাস্থানহাট, সোনাতলা কলেজ হাট, ডাকুমারা হাটসহ বিভিন্ন হাট থেকে বেছে বেছে গরু কেনেন। মাংস বিক্রির জন্য দোকানে পাঁচজন সহকারী আছেন। পড়াশোনার ফাঁকে দোকানে বসেন বড় ছেলে হোসাইন আল মাহমুদ।

হোসাইন আল মাহমুদ আরও বলেন, আগে একজন ক্রেতা এক মণ থেকে তিন মণ পর্যন্ত মাংস কিনে নিয়ে যেতেন। কেউ পাইকারি কিনে নিয়ে গিয়ে অন্য এলাকায় খুচরা বিক্রি করতেন। এতে খুচরা ক্রেতারা মাংস কিনতে এসে ফিরে যেতেন। এ কারণে কেউ যাতে এখান থেকে মাংস কিনে নিয়ে ব্যবসা করতে না পারেন, এ জন্য একজন ক্রেতার কাছে সর্বোচ্চ ৩০ কেজি এবং সর্বনিম্ন ১০০ গ্রাম মাংস বিক্রি করা হচ্ছে। এখানে প্রকাশ্যে সুস্থ-সবল গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করা হয়। গরু কেনা হয় আশপাশের হাট থেকে।

বাজারদরের চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি করার কারণ জানতে চাইলে হোসাইন আল মাহমুদ বলেন, ৭০০ টাকা কেজি দাম দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে মাংস খাওয়া সম্ভব নয়। তাই নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে কম দামে গরুর মাংস বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

হোসাইন আল মাহমুদ আরও বলেন, ‘কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করায় অন্য ব্যবসায়ীরা হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরছেন। বিনা কারণে শত্রুতা শুরু করেছেন। কম দামে মাংস বিক্রি না করার জন্য আশপাশের হাটের ইজারাদারও চাপ দিচ্ছেন। তবে ক্রেতারা সঙ্গে থাকলে এবং প্রশাসন সহযোগিতা করলে এভাবে বাজারদরের চেয়ে কম দামে মাংস বিক্রি অব্যাহত রাখতে চাই।’

হোসাইনের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই ২৫০ গ্রাম গরুর মাংস কিনতে আসেন অটো ভ্যানচালক ইদরিস আলী। তিনি বলেন, পরিবারে চারজন সদস্য। ৫৮০ টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কেনার সামর্থ্য নেই। তবে এই দোকানে কম দামে এবং কম পরিমাণ মাংস বিক্রি হওয়ায় গরুর মাংসের স্বাদ নিতে পারছেন।

গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আফতাবুজ্জামান-আল-ইমরান বলেন, হাট এলাকার বাইরে কেউ কম লাভে মাংস বিক্রি করতে চাইলে তাঁকে বাধা দেওয়ার এখতিয়ার কোনো ইজারাদার বা অন্য ব্যবসায়ীদের নেই। নজরুল সততার সঙ্গে কম লাভে মাংস বিক্রি করলে উপজেলা প্রশাসন তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে।