রাজশাহীর সাহেববাজার কাঁচাবাজারে গত শুক্রবারও নিত্যপণ্যের মূল্য তালিকার বোর্ডটি দেখা গেলেও শুক্রবার দুপুরের পর থেকে আর নেই | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি রাজশাহী: ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্য গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’ কবি শঙ্খ ঘোষের এই কবিতার মতো অবস্থা হয়েছে রাজশাহীর সাহেববাজার কাঁচাবাজারের পণ্যের মূল্যতালিকার। সবশেষ তিন বছর আগে হালনাগাদ করা হয় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের এই তালিকা। সেটির মুখের ওপরে একজন গুদাম ভাড়ার বিজ্ঞাপন সেঁটে দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে শনিবার দুপুরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার ৩০ মিনিটের মধ্যে সেটি খুলে গুদামঘরে ঢোকানো হয়েছে। এখন এই বাজারে আর কোনো মূল্যতালিকাও নেই।

গত শুক্রবার দুপুরে সাহেববাজার কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, দুই দিন আগের ৪০ টাকা কেজির বেগুনের দাম হাঁকা হচ্ছে ৭০ টাকা। দুই দিনের ব্যবধানে কে এই দাম বাড়াল জানতে চাইলে মো. জামাল নামের একজন দোকানি তাঁর পাশের দোকানে ঝোলানো গরুর মাংসের পিন্ডের দিকে তাকিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘ওটা ৭০০ টাকা হলো কী করে?’ এরপর তিনি তাঁর নানার সম্পত্তির দাম কতগুণ বেড়েছে, সে নিয়ে গল্প বলে প্রতিবেদকের কাছে জানতে চাইলেন, ওই জমির দাম কে বাড়িয়েছে? তাঁর এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে আসতে চাইলে তিনি আবার ডেকে জানতে চাইলেন। কোনো জবাব নেই জানালে জামাল বললেন, ‘এখানেই কবির কলমের কালি শেষ!’

একজন তরকারিওয়ালার কথার খোঁচা খেয়ে বাজারের মূল্যতালিকার বোর্ডের কাছে গিয়ে দেখা গেল, সেটি ২০২০ সালের ২২ মার্চ সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছে। বোর্ডের এক পাশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নাম লেখা। তাঁর ডান পাশে মাপের একক কেজি ও বাজারদর লেখার জায়গা রয়েছে। চক পেনসিল দিয়ে হালনাগাদ করা বোর্ডের মূল্যতালিকা মুছে গেছে। এই বোর্ডে গরুর মাংস, কাঁচা মরিচ, আলু ও আদার কথা লেখা থাকলেও বেগুনের দামের কোনো ঘর নেই। ফলে ওই তরকারিওয়ালার কাছে আর ফিরে যাওয়া হলো না।

রোজার মাসে ইফতারে বেগুনি করার জন্য বেগুনের চাহিদা বাড়ে। অন্য একটি দোকানে বেগুনের দাম জিজ্ঞেস করলে দোকানি হাঁকলেন, ৮০ টাকা কেজি। অবশ্য বেগুনগুলো বেশ বড়। দুই দিন আগের দাম জানতে চাইলে দোকানি বললেন, এটা রোজার বাজার ধরার জন্যই বিশেষভাবে চাষ করা হয়। দুই দিন আগে তো ছিলই না। তবে সাধারণ বেগুনগুলোর দাম ৩০ টাকা কেজি থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে।

দুই দিন আগে এই বাজারের একটা বড় লেবুর দাম ছিল ১০ টাকা। রোজার দিন থেকে সেটি ২০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। বিচিবিহীন ‘চায়না-থ্রি লেবুগুলো ছোট-বড় ভেদে ৪০ থেকে ৫০ টাকা হালি দাম চাওয়া হচ্ছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুর গ্রামের চাষি মাজাহারুল ইসলামের ২০ বিঘা জমিতে এই লেবুর বাগান রয়েছে। গত ডিসেম্বর তিনি বলেছিলেন, তাঁর লেবু ৩১ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী সাহেববাজারে বিক্রি করতে গেলে প্রতি হাজারে ৪৫০ লোকসান হয়। সেই জন্য তিনি লেবু বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ৬ ডিসেম্বর বাগানে গিয়ে দেখা যায়, লেবু পড়ে বাগানের মাটি ঢেকে আছে। তিনি তখন বলেছিলেন, রোজার মাসের দিকে তাকিয়ে আছেন।

বর্তমানে লেবুর দর জানতে চাইলে মুঠোফোনে তিনি বললেন, এখন তো লেবুর মৌসুম নয়। কাঁচা লেবুই বাগান থেকে পাইকারি ক্রেতারা ২০ টাকা হালি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছেন। হিসাব করে দেখা গেল ৩১ কিলোমিটার আসতেই সেই লেবুর দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।

এবার রোজা শুরুর আগের দিন রাজশাহী জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে গঠিত একটি বাজার তদারক কমিটি এই বাজার পরিদর্শন করেছে। ওজনে কম দেওয়ার জন্য এক মাছ বিক্রেতাকে জরিমানা করা হয়েছে। বাজারের মূল্যতালিকার ব্যাপারে রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রোজার আগের দিন বাজার তদারকের সময় তিনিও ছিলেন। তাঁর দপ্তরের পরিদর্শক পাঁচ দিনই বাজারের দোকানে দোকানে মূল্যতালিকা দেখে আসেন। তিনিও সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ দিন যান। তবে তিনি দাবি করেন ওই মূল্যতালিকার বোর্ড সিটি করপোরেশনের তদারক করার কথা।

এ বিষয়ে গতকাল দুপুরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. নূর-ই-সাঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁদের বাজার শাখার লোকজন এটি প্রতিদিন হালনাগাদ করে থাকেন। এটি তিন বছর আগে সর্বশেষ হালনাগাদ করার বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ফোনালাপের ৩০ মিনিট পরেই মূল্যতালিকার বোর্ডটি খুলে নেওয়া হয়। সেটি বাজার শাখার কার্যালয়ে রাখা হয়। এই কার্যালয়ের সহকারী মো. হানিফ বলেন, তাঁদের বড় কর্মকর্তার ফোন পেয়ে এটি খুলে ঘরে রাখা হয়েছে। বোর্ডটি দেখতে চাইলে তিনি বলেন, তার বড় কর্মকর্তা না বললে তিনি আর ঘর খুলে বোর্ড দেখাতে পারবেন না।

বোর্ড খুলে নেওয়ার ব্যাপারে পুনরায় ফোন করা হলে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন, তিনি বাজার শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বোর্ডটি নষ্ট হয়ে গেছে। সেই জন্যই খুলে নিয়েছেন।