ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) | ছবি: রয়টার্স

কূটনৈতিক প্রতিবেদক: ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে গত বছর অন্তত ৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অনুপ্রবেশ করেছে। ২৭ সদস্যের জোটের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশের এই হার ২০২১ সালের তুলনায় ৬৪ শতাংশ বেশি। আর ২০২২ সালে ইইউয়ের দেশগুলোতে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ২৪ হাজার। ২০২১ সালের তুলনায় তা ৪৬ শতাংশ বেশি। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ অভিবাসীদের দ্রুত ফেরাতে যে উৎস দেশগুলো সহযোগিতা করছে না, তাদের ওপর ভিসা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপে ইইউকে নির্দেশনা দিয়েছে ইউরোপীয় কাউন্সিল।

গত বৃহস্পতিবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কাউন্সিলের বিশেষ বৈঠকে এই নির্দেশনার সিদ্ধান্ত হয়। বিশেষ বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও অবৈধ অভিবাসন ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি বৈঠকে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।

গত বছরের জুনে প্রকাশিত ইইউয়ের আশ্রয়প্রার্থী-বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে অন্তত ৬ লাখ ৪৮ হাজার ব্যক্তি ইউরোপের দেশগুলোয় আবেদন করেছেন। এই তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও ছিল।

বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈঠক শেষে প্রচারিত ঘোষণায় বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ও প্রাণহানি রোধে ইইউয়ের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি ইউরোপের সীমান্তসহ জোটের সদস্যদেশগুলোর ওপর অবৈধ অভিবাসনের চাপ কমাতে হবে।

ঘোষণায় বলা হয়, মানব পাচারকারীদের প্রতিহতের পাশাপাশি অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করা লোকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো নিশ্চিতে ইইউয়ের প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে। এই লক্ষ্যে যে দেশগুলো সহযোগিতা করবে না, তাদের ক্ষেত্রে ভিসা–সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ করবে ইইউ। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা সংকোচনের মতো কূটনৈতিক হাতিয়ার ইইউ ব্যবহার করবে।

১৫ পৃষ্ঠার ঘোষণা
ইউরোপীয় কাউন্সিলের ঘোষণাটি ১৫ পৃষ্ঠার। এতে ইইউর ভিসা–সংক্রান্ত আইনের ২৫ (ক) ধারার আওতায় বিদ্যমান কাঠামোর পূর্ণ ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তনে সহযোগিতা না করা দেশগুলোর জন্য ভিসা সীমিত করে দিতে জোটের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় কাউন্সিল।

ইইউয়ের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ও অগ্রাধিকার ঠিক করে ইউরোপীয় কাউন্সিল। সদস্যদেশগুলোর রাষ্ট্র-সরকারপ্রধান, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্টের সমন্বয়ে কাউন্সিল গঠিত। সাধারণত ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈঠকে ইইউয়ের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতি–বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি অংশ নেন। 

ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কাউন্সিলের সবশেষ বৈঠকে অবৈধ অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ও কার্যকর নীতি প্রণয়নের গুরুত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।

বৈঠকে বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের যাতে নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, সে জন্য দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসীদের উৎস দেশগুলোর পাশাপাশি ট্রানজিট দেশগুলোকে যুক্ত করে ইইউয়ের কূটনৈতিক তৎপরতাসহ সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগে বাণিজ্য, ভিসা ও বৈধ অভিবাসনের সুযোগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বৈঠকে ভিসামুক্ত ব্যবস্থা ও অভিবাসন ব্যবস্থাপনা টেকসই করতে ইইউয়ের প্রতিবেশী দেশগুলোর ভিসা নীতির সঙ্গে জোটটির ভিসা নীতির সামঞ্জস্য রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পশ্চিম বলকান অঞ্চলের দেশগুলো ইতিমধ্যে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। ইউরোপীয় কাউন্সিল এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।

ইউরোপীয় কাউন্সিলের বিশেষ বৈঠকে সদস্যদেশগুলোকে অভিবাসন প্রশ্নে পরস্পরের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয়ের জন্য ঝুলে থাকা আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

অবৈধ অভিবাসন প্রশ্নে ইইউয়ের কঠোর অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত গত মাসের শেষ সপ্তাহেই এসেছিল। ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈঠকের ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে কোনো দেশের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসী উৎস দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আছে। লিবিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে মধ্য ভূমধ্যসাগর হয়ে নৌপথে ইউরোপে অবৈধভাবে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের তালিকায় তৃতীয় শীর্ষ স্থানে বাংলাদেশ।

অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনতে চাপের মুখে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ইইউয়ের সঙ্গে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষর করে। এসওপির আওতায় অবৈধ অভিবাসীদের পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে তাঁদের ফিরিয়ে আনছে বাংলাদেশ।

করোনা মহামারির শুরুতে অবৈধ লোকজনকে ফেরানোর প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। তখন ইইউ বাংলাদেশিদের ভিসার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের হুমকি দিয়েছিল। পরে বাংলাদেশ লোকজনকে ফেরানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এতে ইইউ তার কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছিল।