জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তনে বক্তব্য দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। শনিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘আজকাল রাজনীতিতে ক্ষমতা আর অর্থবিত্তের দাপটই নিয়ামক শক্তি হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ছাত্ররাজনীতিতে এসব অশুভ ছায়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। দখলবাজি আর চাঁদাবাজির কারণে ছাত্ররাজনীতিকে এখন আর মানুষ আগের মতো সম্মানের চোখে দেখে না।

নেতিবাচকভাবে দেখে। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুখকর নয়।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তনে শনিবার সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বেলা তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সমাবর্তনের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। সভাপতিত্ব করেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। স্বাগত বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. নূরুল আলম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (চুক্তিভিত্তিক) রহিমা কানিজ।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ খেলাপি ঋণের ১ শতাংশের জন্যও সাধারণ মানুষ দায়ী নয় বলে উল্লেখ করেন। বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতিই বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি হন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শনিবার বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ষষ্ঠ সমাবর্তন’ অনুষ্ঠানে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত এক শিক্ষার্থীকে পদক প্রদান করেন  | ছবি: ফোকাস বাংলা

আবদুল হামিদ বলেন, তাঁরা (ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি) ঋণ নেন শোধ না করার জন্য। অবশ্য এর সঙ্গে একশ্রেণির ব্যাংককারদেরও যোগসাজশ থাকে। চাকরিজীবীরাও কীভাবে গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়া যায়, সেই চিন্তায় বিভোর থাকেন। ভুলেই যান যে তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও জনগণের সেবক। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য অনেক সময় দেশ ও জাতির বড় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতেও পিছপা হন না।

রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের অশুভ আঁতাত যেকোনো দেশের জন্যই বিপজ্জনক বলে মনে করে রাষ্ট্রপতি বলেন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় একটি দেশ উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। এর ব্যত্যয় হলে দেশ ও জাতির জন্য বয়ে আনে চরম বিপদ। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসা শুরু করেই চিন্তা করেন কীভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায়। নীতিনৈতিকতা বাদ দিয়ে কীভাবে শুধু নিজে বড়লোক হতে পারবেন, সেই চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত থাকেন।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, একটি শ্রেণি ক্ষমতা ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রদের ব্যবহার করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। ইদানীং পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ–বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজির নেতিবাচক খবর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপাচার্য ও শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতার খবরই বড় করে ছাপা হয়ে থাকে। কেবল সনদসর্বস্ব শিক্ষা দিয়ে দেশ ও দশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

সমাবর্তন বক্তা প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সংযোগ কেবল শ্রেণিকক্ষের পাঠদান বা পরীক্ষা গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সে জন্য পেশাগত এবং ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সততা, নিষ্ঠা আর উন্নত নৈতিক মূল্যবোধের প্রগাঢ় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে হবে।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থ মানুষকে অমানুষে পরিণত করতে প্ররোচিত করে। আর প্ররোচিত করে অর্থলোভী হতে, দুর্নীতি করতে, অর্থ পাচার করতে এবং মানবিকতাবোধ ধ্বংস করতে। দুর্নীতিবাজরা অবৈধভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করে এবং রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিচারনীতি এমনকি মৌলিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে। তারা গণতন্ত্রবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, জনগণবিরোধী, জাতিবিরোধী, মানবতাবিরোধী আর ঘৃণিত। আপনারা কোনো কারণেই নিজেদের ওই দলের অন্তর্ভুক্ত করবেন না।’

স্বাগত বক্তব্যে উপাচার্য মো. নূরুল আলম বলেন, বর্তমান সরকারের নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন পাওয়া শিক্ষার্থীরা বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্পে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

সমাবর্তন আয়োজন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সহ–উপাচার্য (প্রশাসন) শেখ মো. মনজুরুল হক। এর আগে বেলা আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে উপাচার্যের নেতৃত্বে সমাবর্তনের শোভাযাত্রা শুরু হয়ে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রভাষক এবং সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যরা অংশ নেন।

এবারের সমাবর্তনে ১৫ হাজার ২১৯ জনের মধ্যে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ১১ হাজার ৪৪৪ জন, উইকেন্ড প্রোগ্রামের ৩ হাজার ৪৬১ জন, এমফিল ডিগ্রির ৩৪ জন ও পিএইচডি সম্পন্নকারী ২৮০ জন অংশ নেন। সমাবর্তনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সব কটি বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরধারী ১৬ জনকে দেওয়া হয় স্বর্ণপদক।

সমাবর্তন উপলক্ষে ক্যাম্পাসকে সাজিয়ে তোলা হয় বর্ণিল সাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), সপ্তম ছায়া মঞ্চ, সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ, অমর একুশ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবন, শহীদ মিনার, নতুন কলাভবন, বটতলা, পরিবহন চত্বর, হলসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা কালো গাউন-টুপি-কস্টিউম পরে সেলফি, গ্রুপ ফটোসেশনে ব্যস্ত সময় পার করেন। বিশেষ এ দিনে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পরিবার নিয়ে প্রিয় আঙিনায় এসেছিলেন অনেকে।