দায়সারা বিচার: আপিলকারী ‘হ্যাঁ’ বললেও বিচারক নথিতে লিখেছেন ‘না’

হাইকোর্ট ভবন | ফাইল ছবি

এস এম নূর মোহাম্মদ: আব্দুর রহমান বগুড়ার দেশমাসিয়াল গ্রামের সফির উদ্দিনের ছেলে। তিনি চাকরি করতেন বগুড়া সদরের সারগুদাম রক্ষক হিসেবে। ওই গুদাম থেকে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৪৯৪ টাকার সার আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয় ১৯৮২ সালে। তাঁর বিচারে নিম্ন আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন এবং সমপরিমাণ টাকা অর্থদণ্ড দেন। সেই দণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হলে অতিরিক্ত ছয় মাসের দণ্ড ভোগ করার নির্দেশ দেন আদালত। রায়ের পর কারাগারে যেতে হয় তাঁকে।

তবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন আব্দুর রহমান। তাঁকে খালাস দিয়ে সেই আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে ৩১ বছর পর। কিন্তু রায় জানা তাঁর পক্ষে কোনো দিন সম্ভব হবে না। কারণ, ২০০১ সালেই তাঁর মৃত্যু হয়। বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীর বেঞ্চে গত বছর নিষ্পত্তি হওয়া মামলাটির পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঘটনাকাল বিবেচনায় মামলাটির বয়স ৩৯ বছর। দীর্ঘ সময় মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য কোনো পক্ষই কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আব্দুর রহমানের ৬৬ বছর বয়স্ক স্ত্রী হাজেরা খাতুন এখনো বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, ‘তিনি (আব্দুর রহমান) অনেকবার বলেছেন, ওই ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। এখন খালাস পেয়েছেন শুনে ভালো লাগছে। তবে তিনি শুনে যেতে পারলেন না।’

হাজেরা আরও বলেন, সাজা হওয়ার কারণে তাঁর স্বামী শিক্ষিত হলেও ভালো চাকরি হয়নি। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে পাঁচ ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্টে মানুষ করতে হয়েছে। তাঁকে বাড়িতে থাকতে হয়েছে। তাঁর স্বামী সরকারি যেসব সুযোগ-সুবিধা পেতেন, এখন যেন তাঁকে সেসব সুবিধা দেওয়া হয়। যাতে শেষ বয়সে একটু ভালো থাকা যায়।

১৯৮২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গুদাম রক্ষক আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার পর ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল হয়। বিচারিক আদালত দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ১৯৯১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন। কারাগারে থেকেই এক মাস পর নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ২৩ অক্টোবর উচ্চ আদালতে আপিল করেন তিনি। সেই সঙ্গে চান জামিন। আবেদনের ছয় দিন পর মিলে জামিন। আর আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত হয় ১৯৯৫ সালের ৫ জুন। তবে সেই আপিল আর শুনানি হয়নি দীর্ঘ সময়। বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে এই মামলাও শুনানির জন্য উঠে আসে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সাফাই সাক্ষ্য দেবেন কি না—গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আপিলকারী ‘হ্যাঁ’ বললেও বিচারক নথিতে ‘না’ লিখেছেন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অভিযোগ গঠনের সময় এবং সাক্ষ্য গ্রহণের পর মামলা শেষ হওয়ার আগে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। বিচারক অবশ্যই অভিযুক্তের সামনে ঘটনার বিবরণসহ পরীক্ষিত সাক্ষীদের বক্তব্য বা অন্য কোনো দালিলিক সাক্ষ্য; যা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দণ্ড ও সাজা প্রদানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে, তা বোধগম্য ভাষায় বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করবেন। যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতের সামনে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে সঠিক উত্তর দিতে পারেন।

এর আগে এই মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পক্ষভুক্ত হতে আবেদন করলে ২০২১ সালের ৭ মার্চ তা মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। তবে ৩৯ বছরের পুরোনো মামলার আপিলকারী জীবিত আছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠে আদালতে। পরে দুদকের আইনজীবী অনুসন্ধান করে ওই বছরের ১৫ নভেম্বর হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়, আপিলকারী মো. আব্দুর রহমান ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বার্ধক্যের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে তিনি ২০০১ সালের ৩১ মে মারা গেছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

আসামির শ্বশুর ছবির উদ্দিন ও স্ত্রী হাজেরা খাতুন আব্দুর রহমানকে নির্দোষ দাবি করে আদালতের সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার সময় তাঁরা সরকারি বাসায় বাস করতেন। প্রজেক্ট অফিসার আবুল হোসেন তাঁদের পাশের বাসায় বাস করতেন। আব্দুর রহমান বাসা থেকে কোথাও পালিয়ে যাননি, তাঁর সঙ্গে কোয়ার্টারে ছিল। গুদামের চাবি তিনি বাসায় নিয়ে আসতেন না।

একটি চিঠির ভিত্তিতে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘চিঠিটি আসামির হাতের লেখা’—স্ত্রীর এরূপ বক্তব্য বিশ্বাস করে মামলা প্রমাণ করা হয়েছে। হাইকোর্ট বলেন, এই মামলার রায়ে ‘আসামির লেখা চিঠিকে মামলা প্রমাণে শক্তিশালী দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে’ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় পরীক্ষাকালে বিচারক চিঠি সম্পর্কে আসামির বক্তব্য আছে কি না, তা শ্রবণ করেননি। এই মামলার ক্ষেত্রে বিচারক সম্পূর্ণ দায়সারাভাবে ৩৪২ ধারার নির্দেশনা পালন করেছেন, যা আইনসম্মত না হওয়ায় আপিলকারী আইনানুগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। 

‘মামলাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ না হওয়ায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলটি মঞ্জুর করা হলো। আপিলকারীকে প্রদত্ত দণ্ড ও সাজার দায় থেকে খালাস দেওয়া হলো।’

চিঠির বিষয়ে হাজেরা খাতুন  বলেন, ‘সে সময় উকিল আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, আমি যেন বলি ওই চিঠি তাঁর (স্বামীর) হাতের লেখা। হয়তো উকিল ওই পক্ষের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছিল। আমাকে যা বলতে বলেছে, আমি তা-ই বলেছি।’