রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা গ্যাস-সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাস থাকছে না | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মানসুরা হোসাইন: রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় চারতলা ভবনের নিচতলায় স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন নওরিন সুলতানা। একচিলতে বারান্দায় দুটি চুলা রাখা। একটি চুলা মাটি দিয়ে, আরেকটি টিনের কৌটা কেটে বানানো। বেলা দেড়টার দিকে নওরিন ওই দুই চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করছিলেন। রান্নাঘরে ঢুকে দেখা গেল, দুটি গ্যাসের চুলার ওপরে হাঁড়িপাতিল বসানো।

গ্যাসের চুলা থাকতে লাকড়ি দিয়ে কষ্ট করে কেন মাটির চুলায় রান্না করছেন, এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে নওরিন ম্যাচের কাঠি দিয়ে গ্যাসের চুলা জ্বালানোর চেষ্টা করলেন। তিনটি কাঠি জ্বালানোর পর গ্যাসের চুলায় যেটুকু আগুন দেখা গেল, তা নিবু নিবু মোমের বাতির চেয়ে কম তেজের।

নওরিন আবার বারান্দায় গিয়ে দ্রুত রান্না শেষ করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর দেড় বছর বয়সী মেয়ে ততক্ষণে খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছে। নওরিন রান্না করতে করতে বললেন, বারান্দায় চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করা যেমন কষ্টের, তেমনি ঝুঁকিও আছে। লাকড়ির জন্য বাড়তি ৫০০ টাকা খরচ আছে। গ্যাস আসবে সেই রাত একটার পর। সেই গ্যাস থাকবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। বললেন, তিনি ১ হাজার টাকা গ্যাস বিলসহ ১১ হাজার টাকা বাড়িভাড়া দেন।

নওরিনের মতো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা এমনই গ্যাস-সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাস থাকে না। গভীর রাতে গ্যাস এলে তাঁদের রান্না করতে হচ্ছে। তবে গ্যাসের চুলায় আগুন থাকুক বা না থাকুক, রান্না হোক বা না হোক, মাস শেষে নির্ধারিত গ্যাস বিল দিতেই হচ্ছে। গ্যাস-সংকটে নওরিনের মতো লাকড়ি বা ইলেকট্রিক চুলা, রাইস কুকার, স্টোভ বা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে বিকল্প উপায়ে রান্না করছেন। এতে তাঁদের বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে ক্ষোভের আঁচ পাওয়া গেল। তাঁদের এক কথা, গ্যাস পাচ্ছেন না, কিন্তু গ্যাসের বিল দিতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে হাঁসফাঁস অবস্থার সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্যাসের যন্ত্রণা। শীতকাল বলে বিদ্যুতের বাড়তি দাম দিতে হলেও ভোগান্তি টের পাওয়া যাচ্ছে না, গরমে এ ভোগান্তির মাত্রা কতটুকু বাড়বে, তা ভেবেই একেকজন আঁতকে উঠছিলেন।

সরকার গত ১৮ জানুয়ারি প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ৮২ শতাংশ বাড়িয়েছে। তবে বাসাবাড়িতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। বাসায় দুই চুলার ক্ষেত্রে মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং এক চুলার ক্ষেত্রে ৯৯০ টাকা। এর মধ্যেই গতকাল থেকে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম একলাফে ২৬৬ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি ফেব্রুয়ারির জন্য প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা, যা জানুয়ারি মাসে ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা।

গ্যাসের চুলা না জ্বলায় অনেকে মাটির তৈরি চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করছেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলার পাড় এলাকার ব্যবসায়ী মো. আমজাদ হোসেনের চারতলা বাড়িতে ১১টি পরিবার দুই চুলা ব্যবহার করেন। আমজাদ বললেন, রাত একটার দিকে গ্যাস আসে। ভোর হতেই আবার চলে যায়। কোনো দিন ভোরে গ্যাস থাকলেও জ্বলে টিমটিম করে। ছয় মাস আগেও গ্যাসের বিল দিতে হতো ৯৭৫ টাকা, সেই বিল বেড়ে এখন হয়েছে ১ হাজার ৮০ টাকা।

আরেক বাড়ির মালিক আবদুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, রাতে যে সময়টুকু গ্যাস পাওয়া যায়, তাতে অনেক সময় ভাত রান্নাও শেষ করা যায় না। যে নারীরা পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে কাজ করছেন, তাঁরা সারা দিন কাজ করে ঘরে ফিরে রান্নার জন্য রাত জেগে বসে থাকেন। ঘুম হয়নি বলে পরের দিনের কাজে তো আর কোনো ছাড় পাওয়া যায় না।

কাজলার পাড় এলাকার বাড়ির মালিক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, গ্যাস-সংকটে এলাকাবাসী ভুগছেন প্রায় তিন বছর ধরে। তবে গত কয়েক মাসে ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘নিজের, ভাড়াটেদের বিলসহ মাসে গ্যাসের বিল দিই ১৩ হাজার টাকা, কিন্তু ১৩ টাকারও লাভ পাই না। ভাড়াটেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ভাড়াটেদের ধরে রাখতে ভাড়া কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। ভাড়াটেরা মাটির চুলায় রান্না করে ঘরবাড়ি বরবাদ করে দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই।’

বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে জালাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার সময় এলাকার শহীদুল ইসলামসহ একাধিক বাড়িওয়ালা, সবজি বিক্রেতা, রিকশাচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়ো হন। গ্যাসের প্রসঙ্গে একেকজনের একেক রকম ক্ষোভ। বাড়ির মালিকেরা জানালেন, শুধু রান্নার পেছনেই পরিবারপ্রতি কম করে হলেও পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অনেকে ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে খাচ্ছেন, অনেকে ঋণ নিয়েও খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

গ্যাস-সংকটের কারণে অনেকে রাইস কুকারের মতো বিকল্প ব্যবস্থায় রান্না করছেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রিকশাচালক মোতালেব, কৃষিকাজ করা আবদুল লতিফ বলেন, রাত একটা-দেড়টার দিকে যখন গ্যাস আসে, তখন গ্যাসের লাইনে পানি থাকে। ভবনের বাইরে বিশেষ চাবি ঘুরিয়ে লাইন থেকে প্রথমে হাওয়া বের করে পরে পানি বের করে দেওয়ার কাজ করছেন তাঁরা। বললেন, রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। দিনের বেলা ঝিমুনিতে কাটে। অনেক সময় রুটি, কলা খেয়ে কাটাতে হয় বলে পেটের খিদেও মেটে না।

এলাকার অনেক বাসা, দোকান ও হোটেলে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। অনেক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, সিলিন্ডারের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ১২ কেজির সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকা বা তার বেশি দামে। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে এলাকাবাসীর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনো এলপিজি গ্যাসের দাম বাড়ার খবরটি ওই এলাকায় পৌঁছায়নি।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা জালোওয়াশান আখতার খান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সকাল আটটা থেকে বিকেল পর্যন্ত চুলায় গ্যাস সামান্যই থাকে বা থাকেই না। গ্যাসের প্রিপেইড মিটারে এক হাজার টাকা ভরলে এক মাসের কিছু বেশি সময় যায়। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে রান্না করছেন। খরচ বাড়লেও নাতিদের স্কুলের টিফিন দেওয়াসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা ভেবে এভাবেই রান্না করতে হচ্ছে।

উত্তরার আজমপুরের ফরিদ মার্কেটের কাছে এক কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবারের চালক আরিফুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার গাড়িতে বসেই এ চালকের সঙ্গে কথা হয়। বললেন, রান্নার সময়েই তো গ্যাস থাকে না। ভোর পাঁচটার সময় রান্না করতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী গ্যাস পাননি। তাই রান্না হয়নি। যেদিন রান্না হয়, সেদিন তিনি ভাত-তরকারি সঙ্গে নিয়েই বের হন। দুপুরে হোটেলে খেতে কম করে হলেও ১২০ টাকা লাগবে। সকালে পাউরুটি কলা কিনতে ৫০ টাকা লাগছে।

আরিফুল ইসলাম জানালেন, তিনি এক কক্ষের ভাড়া দেন ৪ হাজার ৮০০ টাকা। এর সঙ্গে তিন বছর ও ছয় মাস বয়সী দুই সন্তানের ভরণপোষণের খরচ আছে। তিনি যে গাড়িটি চালাচ্ছেন, প্রায় তিন লাখ টাকায় নিয়েছেন। মাসে ২০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। খাবারের তালিকা থেকে দুধ, ডিম কমিয়ে দিয়েছেন। বললেন, কপাল ভালো বলে বাড়ির মালিক এখনো ভাড়া বাড়াননি। গ্যাস, পানিসহ অন্যান্য বিলও মালিক দিচ্ছেন।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মুঠোফোনে বলেন, গ্যাস নিয়ে মানুষের ভোগান্তি সবাই অনুভব করছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় জানা নেই। দেশে গ্যাসের সংকট রয়েছে। গ্যাসের দাম বিভিন্ন সময় বাড়ানো হচ্ছে। সরকারের কাছে আবেদন, গ্যাসের আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে বাসাবাড়িতে অন্ততপক্ষে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দিক।