বিজয়ীর বেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ফারাজী আজমল হোসেন : ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য, আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি।’ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, আবেগভরা কণ্ঠে অশ্রুসিক্ত হয়ে কথাগুলো বলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তার সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৫১তম বর্ষপূর্তি। ৭ মার্চ যার বজ্রকণ্ঠ শুনে রিক্তহস্তে যুদ্ধে নেমেছিল এই দেশের মানুষ, সেই মানুষটার একটাই স্বপ্ন ছিল। আর তা হলো ‘সোনার বাংলা’ গড়া।

২৫ মার্চের মধ্যরাত। ইপিআরের ওয়্যারলেস থেকে প্রচারিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এটিই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠার আহ্বান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশকে স্বাধীন করে মুক্তিবাহিনী। যুদ্ধ শেষে দিশাহারা এক নতুন জাতি অপেক্ষা করছিল তাদের নেতার জন্য। ২৯০ দিনের বন্দিদশা শেষে ফিরে আসেন তিনি। দিনটি ১০ জানুয়ারি। বাঙালি জাতি যে দিনকে পালন করে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ হিসেবে।

রাজনৈতিক জীবনে কারাবন্দি হওয়া, মুক্তি পাওয়া বঙ্গবন্ধুর জন্য নতুন কিছু ছিল না। বরং জীবনে বারবার শাসকগোষ্ঠীর রোষানলের শিকার হয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন বঙ্গবন্ধু। মুক্তিও পেয়েছেন। তবে এবারের মুক্তি ছিল এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। যে দেশের জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। সেই দেশ মুক্ত হয়েছে। সেখানে তিনি ফিরেছেন জাতির জনক হয়ে।

স্বাধীন দেশে এসে তাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিমানবন্দর থেকে তাকে বরণ করতে অপেক্ষা করছিল লাখ লাখ মানুষ। বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যান। যেখানে তিনি লাখো উল্লসিত বাঙালির সামনে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনায় ভাষণ দেন। তিনি যুদ্ধকালীন সবার অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি বললেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার করে সামরিক জিপে তুলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেই রাতে তাকে আটক রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে। পরদিন তাকে নেয়া হয় ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে, সেখান থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করাচি নেয়া হয়।

এর আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সামরিক অভিযানের সাফাই গেয়ে জানান, ‘তিনি (শেখ মুজিব) এ দেশের ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত হেনেছেন- এই অপরাধের শাস্তি তাকে পেতেই হবে। ১২ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে ক্ষমতালোলুপ দেশপ্রেমবর্জিত কতক মানুষ, সেটা আমরা হতে দিতে পারি না। আমি সেনাবাহিনীকে আদেশ দিয়েছি তাদের কর্তব্য পালন এবং পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য।... আর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’

এই একই সময় আটক করা হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের বাকি সদস্যদের। তাদের ধানমন্ডি ৩২ থেকে গ্রেপ্তার করে রাখা হয় স্যাঁতস্যাঁতে এক ঘরে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস। সম্মুখে বজ্রকণ্ঠে বক্তব্য দেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের থেকেও কারাবন্দি শেখ মুজিব ছিলেন আরও দৃঢ়, আরও ভয়াবহ। এই বিষয়ে তথ্য মেলে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকির স্মৃতিকথন ইস্ট পাকিস্তান দ্য এন্ডগেম গ্রন্থে। তিনি ৩০ মার্চের ঢাকার বর্ণনা দিয়েছেন যখন আর্মি জিপ নিয়ে শহর ঘুরে ফিরছিলেন নবাবপুর রোড হয়ে। তার জবানিতে জানা যায়, ‘নবাবপুর রোড দিয়ে যাওয়ার সময় এক তরুণ আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল উদ্ভ্রান্ত, আমরা থামতেই সে চেঁচাতে শুরু করল। তার চেহারা-সুরত একেবারে ছন্নছাড়া। সে বলল, বাঙালিরা দৃঢ় পণ করেছে তারা শেখ মুজিবকে মুক্ত করবে, এ দেশকে স্বাধীন করবে। কিছুক্ষণ তার কথা শুনে আমরা আবার জিপে উঠলাম। এই অচেনা আগন্তুকের সঙ্গে বাদানুবাদ করে লাভ নেই, কারফিউ জারি করা এলাকায় সে এক নিঃসঙ্গ পথচারী মাত্র।’

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ইরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন নিয়ে বড় আকারে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ইরানি সংবাদদাতা আমির তাহিরি রাওয়ালপিন্ডির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার ঢাকা সফরের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। রিপোর্টে বিচার যে অত্যাসন্ন, সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়, ‘আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড।’

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির চকলালা বিমানঘাঁটিতে ছাড়তে নিজেই গিয়েছিলেন ভুট্টো। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো কথা না বাড়িয়ে, পেছনের দিকে আর না তাকিয়ে সোজা বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দুই দিন লন্ডনে অবস্থান করে ৯ জানুয়ারি তিনি ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিলেন। মাঝে কয়েক ঘণ্টার জন্য দিল্লিতে নেমেছিলেন তিনি।

৮ জানুয়ারি খবর আসে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে খুব ভোরে লন্ডন পৌঁছেছেন। ৯ জানুয়ারি টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে প্রায় ৩০ মিনিট আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান শ্রীমতী গান্ধী এবং অনুরোধ করেন ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ৯ জানুয়ারি রাতে রওনা হয়ে ১০ জানুয়ারি দুপুরে দিল্লিতে পৌঁছান তিনি। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে অভ্যর্থনা জানান।

১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে সব শহীদের অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে আসার পর দিন থেকে বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার কাজ শুরু করেন। সেদিনই মন্ত্রিসভার সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেন এবং বৈঠকে সংবিধান প্রণয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন।

দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’ এই বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ও ত্যাগের চিহ্ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট চিরতর মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাত কোটি বাঙালির বুক থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আর এ কারণেই আজ জাতির পিতা স্বমহিমায় টিকে আছেন প্রতিটি বাঙালির মনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে।