কবিতায় মন্ত্রিসভা মাতান ইয়াফেস

স্থপতি ইয়াফেস ওসমান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘ক্রীতদাসের হাসি’ লিখে শওকত ওসমান বাঙালি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি ক্রীতদাস নয়। এই অর্থে তিনি বাঙালিকে জাগিয়েছিলেন। বাঙালি জেগেছে অনেকবার, একাত্তরেও জেগেছিল। তেমনভাবে জেগে ওঠার, জ¦লে ওঠার ঘটনা ইতিহাসে ওই একবারই। তারপর তার নিরন্তর নিজর্¦লন; পেছনে হাঁটার বিরামহীন প্রয়াস। জ¦লে ওঠার স্ফুলিঙ্গ (ইস্ক্রা) দেখা যাচ্ছে না। বাঙালির মুখে-মুখাবয়বে ‘ক্রীতদাসের হাসি’র আভা এখনো দেখতে পাওয়া যায়। সবাই নিজেকে বাঙালি বলতেও অকুণ্ঠ নয়।

সে যাই হোক, এখন তার পুত্র ইয়াফেস জাগিয়ে রাখেন সবাইকে ইয়াফেস ওসমান জাগিয়ে রাখেন মন্ত্রিসভাকে। মন্ত্রিসভার কবি তিনি। পিতার মতো পুত্রও লেখাকেই আশ্রয় করেছেন যেন তা সাধনার চর্যা ও চর্চা ক্ষেত্র। মন্ত্রিসভার গুরুগম্ভীর আলোচনায় যখন ক্লান্তি ভর করে তখনই ডাক পড়ে ইয়াফেস ওসমানের। তখন মৃদুভাষী ইয়াফেস ওসমান স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর কবিতা, তবে রাজনীতিই মুখ্য বিষয়। সমকালীন ঘটনাকে তুলে আনেন তিনি কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। সমাজের দুষ্টচক্রের ‘অপলীলা’র কথা ছন্দময় বিন্যাসে উপস্থাপন করেন। সহজ ও সাবলীল তার বিস্ময় ও ক্ষোভের স্বগত প্রকাশ।

ইয়াফেস ওসমানের কবিতার তারিফ করেন মন্ত্রিসভার সহকর্মীরা। হাততালি দিয়ে, টেবিল চাপড়ে উৎসাহ দেন। তিনি পরম উৎসাহে নতুন লেখার রসদ জোগাড়ে ব্যস্ত হন।

প্রাচীনকালে রাজদরবারে থাকত সভাকবি (পোয়েট লরিয়েট)। কাব্যরচনা আর রাজাকে আনন্দদান তাদের কাজ ছিল। ইয়াফেস ওসমান সভাকবি নন। তবে এ আধুনিককালে উপমিত করে তাকে এমনটা বললেও খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না, যদিও তাতে তার আপত্তি আছে। এটা তার সহজাত কর্মের অনেকগুলোর একটি। লেখক সত্তা তার একান্ত নিজস্ব সত্তা, যাতে তিনি নিজেকে খুঁজে পান; আমোদিত হন এবং সহকর্মীদের আমোদিত করেন।

মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের কবিতা পড়ে চাঙ্গা রাখলেও নিজের কাজে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেন না তিনি। কাঁধে তুলে নিয়েছেন দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পের ভার। সরকারের সাফল্য খানিকটা তার ওপরও ভর করে আছে। কারণ তিনি বাস্তবায়ন করছেন দেশের সবচেয়ে দামি রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প।

এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন অথচ তার মধ্যে ফোকাসে আসার ন্যূনতম চেষ্টা নেই। প্রচারপ্রদীপ থেকে সহস্র হাত দূরে থাকতে চান। নীরবে নিভৃতে নিজের কাজটাই করতে চান সরসভাবে, সফলতার সঙ্গে। মন্ত্রিসভার অনেক সহকর্মীর মতো সাংবাদিক ডেকে বলেন না, ‘প্রকল্পের কাজ ৭০ ভাগ শেষ।’ কিংবা বলেন না যে, ‘এক মাস পর ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হবে।’

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করার ঝক্কি ছিল অনেক। এ কারণে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার ইচ্ছা থাকার পরও কাজ শুরু করতে পারেনি। স্বাধীনতার অনেক দিন পর সাহসী এ সিদ্ধান্ত নিতে ইয়াফেস ওসমানকে সাহস জুগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের গণমাধ্যমগুলো সরব ছিল পারমাণবিক বর্জ্য কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে। শেষে অনেক দেনদরবার করে এ বর্জ্য রাশিয়াতেই নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করান ইয়াফেস ওসমান।

ইয়াফেস ওসমানকে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সঙ্গী করেন দূরবর্তী স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার স্বপ্নে। প্রায় ১৪ বছর আগে সেই যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ঢুকেছেন, আজও সেখানেই আছেন। মন্ত্রণালয়টিতে বাহুল্য বলে কিছু নেই। ঝকঝকে তকতকেও নয় কোনো কিছু। বদলায়নি টেবিল চেয়ারগুলোও।

অন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে কী হয়? মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরই কীভাবে রুমটি জাঁকজমকপূর্ণ করা যায় সেই চিন্তায় মগ্ন হন মন্ত্রী। তাতে তাল দেয় ক্ষমতালিপ্সু কিছু আমলা আর অধিদপ্তরের ঠিকাদার। মন্ত্রীকে কিছু গছাতে পারলেই তাদের লাভ। অধিদপ্তর থেকে টাকা এনে প্রথমেই মন্ত্রীর দপ্তর আধুনিক করা হয়। এরপর সচিবের। পরে পুরো মন্ত্রণালয়কে চকচকে করা হয়। বাহ্যিকভাবে ঝকঝকে তকতকে হলেও ভেতরে সেই ঘুণে ধরা ফাইল চালাচালি। টাকা খাওয়ার মহোৎসব চলে বিরামহীন।

যারা মাঠে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সেই দপ্তরের টাকায় মন্ত্রী বা সচিবের অফিস রুম সাজালে তাদের তদারকি করার কিছু থাকে না। তখন অধিদপ্তরই মন্ত্রণালয় চালায় আর মন্ত্রণালয় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। ইয়াফেস ওসমান এসবের ধারেকাছে যাননি। চতুর আমলাদের ফাঁদে পড়েননি তিনি, সাড়া দেননি চৌকস ঠিকাদারদের প্রলোভনে।

এর পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। মন্ত্রিসভায় ঢুকেছিলেন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। দ্বিতীয় মেয়াদের কিছুদিন পার হওয়ার পর পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। ইয়াফেস ওসমান যখন পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন তখন সেই কেবিনেটের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু। কী গুণে পূর্ণ হলেন ইয়াফেস ওসমান জানতে চাইলে মুজিবুল হক বলেন, ‘তিনি শোনেন বেশি, বলেন কম। এটাই তার প্রধান গুণ। একই গুণের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও “প্রতি” থেকে “পূর্ণ” হয়েছেন।’

জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়েও নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ সংবিধানই তাকে দিয়েছে। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হয়ে ১৩ বছর মন্ত্রী থাকার নজির ইয়াফেস ওসমান ছাড়া আর কারও নেই এ দেশে। রেকর্ড সময় মন্ত্রী থাকার পরও তার নির্বাচন করার কোনো মোহ নেই। তিনি জনগণের কোলাহল এড়িয়ে নীরবে নিজের কাজটাই করতে চান। ঠিক যেমন বিজ্ঞানীরা করে। ইয়াফেস ওসমানের কাজও বিজ্ঞানীদের নিয়েই, যারা সারা জীবন গবেষণা করেই কাটিয়ে দেন। দুনিয়াবির খবর তারা তেমন রাখেন না।

স্থপতি ইয়াফেস ওসমান ১৯৪৬ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামে জন্মেছেন। তার পিতা কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান এবং মাতা সালেহা ওসমান। চট্টগ্রাম মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা। এসএসসি পাস করেন ১৯৬৩ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এরপর নটর ডেম হয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে। স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক হন।

পিতার লেখালেখিতেই পুত্র অনুপ্রাণিত হয়েছেন। শওকত ওসমান বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার অগ্রদূত। বাঙালিকে জাগিয়ে তুলতে লিখেছেন নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা। প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুুন আজাদ শওকত ওসমানকে বলতেন ‘অগ্রবর্তী আধুনিক মানুষ’। পিতার মতো লেখালেখিতে বিখ্যাত না হলেও ইয়াফেস ওসমান স্বনামধন্য কবি। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘নষ্ট কাল কষ্ট কাল’, ‘নয় মানুষ, কয় মানুষ’ এবং জয়তু জননেত্রী উল্লেখযোগ্য।

এখন ভোট থেকে দূরে থাকলেও সারা জীবনই ভোটবিমুখ ছিলেন না তিনি। ইয়াফেস ওসমান ১৯৭০ সালে বুয়েটের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ৭০ সালে বুয়েটের ভিপি ছিলেন তাহলে ৭১ সালে কি বিদেশে উচ্চ ডিগ্রি নিতে চলে গিয়েছিলেন? গরিব মেহনতি মানুষের করের টাকায় লেখাপড়া করে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীরা সচরাচর যা করেন? না, তা নয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, ২ নম্বর সেক্টরে।

স্থপতি হিসেবেও খ্যাতি কুড়িয়েছেন তিনি। জুনিয়র স্থপতি হিসেবে ড. এফ আর খানের সহযোগীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি। পেশাগত জীবনে স্থাপত্য ও নকশা প্রতিষ্ঠান প্রকল্প উপদেষ্টা লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

রূপপুরে নির্মীয়মাণ দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দেশের সবচেয়ে খরুচে এ প্রকল্প শুরু করতে সরকারকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সমঝোতা স্মারক ও বিভিন্ন ধরনের চুক্তি করতে হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) ডেকে এর অবকাঠামো মূল্যায়ন করাতে হয়েছে। সংসদে একাধিক আইন পাস করাতে হয়েছে। এসব কাজ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই জটিল। দীর্ঘ সময় লেগে থেকে এসব কাজ দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিচ্ছেন ইয়াফেস ওসমান। ২০২৪ বা ’২৫ সালে এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলেই তার পরিশ্রম সার্থক হবে। দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেলে আক্ষরিক অর্থেই দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হবে। মন্ত্রীর সাফল্যই দেশের সাফল্য, দেশবাসী কায়মনোবাক্যে তার সাফল্য কামনা করে।