আশির দশকে ছোটদের অনুষ্ঠান ‘কাকলি’ রেকর্ড করছেন প্রয়াত নুরুল ইসলাম এবং মানসী বড়ুয়া | ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

রাহাত মিনহাজ: ২০২২ সালের শেষ দিন ঢাকাসহ সারা দেশে বেশ শীত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো এদিন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেও নতুন বছরকে মানুষ আয়োজন করে বরণ করেছে। তবে এই দিনটি আমার কাছে ছিল বেশ বেদনার। কারণ এদিনটি ছিল আমিসহ কোটি কোটি মানুষের প্রিয় সম্প্রচার মাধ্যম বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিসের শেষ দিন। এদিন রাতের শেষ দুই অধিবেশন ‘প্রবাহ’ ও ‘পরিক্রমা’র মাধ্যমে বিবিসি রেডিও সার্ভিসের সম্প্রচার শেষ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় ‘প্রবাহ’ শুনলাম।

বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৩০ মিনিটে যখন ‘পরিক্রমা’ শুরু হলো, তখন বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়লাম। অনুষ্ঠান উপস্থাপক মানসী বড়ুয়া যখন বলছিলেন ‘...আজকের পরিক্রমা আমাদের শেষ রেডিও অনুষ্ঠান... তাই এই অনুষ্ঠানেও থাকবে গল্প স্মৃতিচারণা...!’ তখন সত্যিই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। বিবিসি বাংলার রেডিও সংবাদের সঙ্গে আমার ভালো করে পরিচয় ২০০৪ সালে। ওই বছর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়েছিলাম। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়াউর রহমান হলের ৪০৭ নম্বর কক্ষে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে জোরে শব্দ ছেড়ে আমরা বিবিসি শুনতাম। এটা ছিল আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস। তখন শুধু আমাদের কক্ষেই নয়, হলের অন্য কক্ষেও জোরে শব্দ ছেড়ে বিবিসি শোনা হতো। এরপর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই অভ্যাস বজায় ছিল।

বিবিসি বাংলার মাধ্যমেই আমি ২০০৬ সালের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সংঘাত-সহিংসতা, ওয়ান ইলেভেন ইত্যাদি বড় বড় ঘটনার সংবাদ শুনেছি। একই সঙ্গে সেনাসদস্যদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ এবং তা থেকে তৈরি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের খবরও শুনেছি বিবিসি বাংলার তরঙ্গে। আমার মনে আছে, ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল রণক্ষেত্র। পুলিশের হলুদ জলকামান জিয়াউর রহমান হলের বাইরের গেটের ওপর দিয়ে গরম পানি ছিটাচ্ছিল। প্রচুর টিয়ারগ্যাস ছোড়া হয় হলের ভেতরে। পুরোনো তোশক, কম্বল পুড়িয়ে আমরা ধোঁয়া তৈরি করে টিয়ারগ্যাসের আক্রমণ থেকে বেঁচেছিলাম। ওই দিন রাত ১০টা ৩০ মিনিটে বিবিসি বাংলায় শুনলাম শাকিল আহমেদের কণ্ঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ভয়াবহ সংঘর্ষ...। মনে আছে সেই সময়ের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশাসন ছাত্রদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালিয়েছিল। একমাত্র বিবিসি বাংলা বিভাগই যথাযথ সংবাদ পরিবেশন করেছিল। আজিজ সুপার মার্কেটে যে ধরপাকড় আর মারধরের ঘটনা ঘটেছিল, তা বিবিসির মাধ্যমেই জেনেছিলাম। দেশের অন্য গণমাধ্যমগুলো তখন ছিল নিশ্চুপ।

ওই সময়ে বিবিসিতে বিভিন্ন ধারাবাহিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। সাংবাদিক শাকিল আহমেদ একবার ফিলিস্তিন থেকে সংবাদ করেছিলেন। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সীমান্ত এলাকার বর্ণনা দিয়েছিলেন। শিহরণ জাগানো সব প্রতিবেদন। এ ছাড়া আলোচিত একটি ধারাবাহিক ছিল কামাল আহমেদের ‘ফৌজি বাণিজ্য’। বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যম এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার সাহস আজও দেখায়নি। অসাধারণ একটি সিরিজ ছিল ‘ফৌজি বাণিজ্য’।

একটু শুরুর কথায় আসি। সাংবাদিকতায় উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করা বিবিসি বাংলা সার্ভিসের যাত্রা শুরু ৮১ বছর আগে। সেই ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর। তখন সম্প্রচার সাংবাদিকতা মাত্র ডানা মেলতে শুরু করেছে। শুরুতে বিবিসি বাংলা সার্ভিসে সপ্তাহে মাত্র একটি নিউজলেটার সম্প্রচার করা হতো। তখন লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংবাদ মিত্রপক্ষের ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেয়া। সেই শুরু। এরপর দিনে দিনে বিবিসি বাংলা সার্ভিস উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে গেছে, যা বিশেষ মাইলফলকে পৌঁছায় ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি বাংলা অথবা বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ছিল বিশেষ এক গণমাধ্যম, যা সারা বিশ্বে নিপীড়িত বাঙালি জাতির করুণ কাহিনি তুলে ধরেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বিবিসি বাংলা ছিল বাঙালির আস্থার প্রতীক। যুদ্ধের ৯ মাসই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পাশাপাশি বাঙালি জাতি কান পেতে থাকত বিবিসি বাংলার তরঙ্গে। এই বিবিসি বাংলা সার্ভিসেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সম্প্রচারিত হয়েছিল হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর। ওই দিন বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ের খবর সম্প্রচারিত হয়েছিল সারা বিশ্বে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন বিবিসি বাংলার কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক সিরাজুর রহমান। তিনি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভরাট কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিবিসি, লন্ডন। এখন গ্রিনিচ মান সময় বিকেল সোয়া চারটে। ভারতের সময় রাত পৌনে দশটা। আর ঢাকার সময় রাত সোয়া দশটা। এখন প্রচারিত হচ্ছে একটি বিশেষ বাংলা অনুষ্ঠান।’

সেদিনের ওই বিশেষ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিজয়ের সংবাদটি পাঠ করেছিলেন সাংবাদিক ও সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। তিনি পাঠ করেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ঢাকায় এক আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে ভারতীয়রা জানিয়েছে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন, যে সাময়িক পরাজয়ের অর্থ যুদ্ধে পরাজয় নয়। ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণ চুক্তিটি পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে বিনা শর্তে করা হয়েছে। আজকের ঘটনাগুলোর শুরু হয়, পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি কমান্ডার আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন- এ ঘোষণা পাবার সঙ্গে সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রচারিত এক বেতার ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেছেন যে, ঢাকায় আত্মসমর্পণপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে পূর্ব পাকিস্তান কমান্ডের পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি স্বাক্ষর দিয়েছেন।’

শুধু এই বিজয়ের সংবাদই নয়, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ নামক নবীন রাষ্ট্রের পথচলা ও নানা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সংবাদ নিরপেক্ষ ও যথাযথভাবে শ্রোতার কাছে তুলে ধরেছিল বিবিসি বাংলা রেডিও। যে যাত্রার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হলো ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে।

বিবিসি বাংলা রেডিওর শেষ অনুষ্ঠান ‘পরিক্রমা’তে বাংলা সার্ভিসের প্রধান সাবির মুস্তাফা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালে বিবিসির শ্রোতা সপ্তাহে ছিলেন প্রায় দুই কোটি। রেডিও যে হুমকি মুখে তখন বুঝতে পারা যায়নি। কিন্তু ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালের দিকে এসে বিবিসি বুঝতে পারে ডিজিটাল ফরম্যাটের দিকে জোর দেয়া প্রয়োজন। তখন বাংলাদেশে ইন্টারনেট, বিশেষ করে মোবাইল ইন্টারনেট দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছিল। যে কারণে ২০১৪ সালের শুরু থেকে বিবিসি বাংলার সব বিনিয়োগ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে করা হয়। তিনি আরও জানান, এরপর বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস একটি ব্যাপক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলে বিবিসির মূল কেন্দ্র থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত আসে।

মনে রাখা প্রয়োজন, বিবিসি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরোনো কাঠামোয় টিকে থাকা সত্যিই কঠিন। বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিস বন্ধ হলেও চালু থাকছে অনলাইন কার্যক্রম। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাবে বিবিসি বাংলা সার্ভিসের খবর। যদিও বিবিসি রেডিও সার্ভিসে সাবির মুস্তাফার কণ্ঠে ‘বিবিসি বাংলা... এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা... একটু পরেই শুনবেন সর্বশেষ বিশ্ব সংবাদ... আপনারা বিবিসি শুনছেন ঢাকায়...’ ইথার তরঙ্গে সেই জাদুকরী শব্দসম্ভার আর শোনা যাবে না। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয় কিছুতেই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা