খেজুরের কাঁচা রস পান করলে মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে | গ্রাফিক্স পদ্মা ট্রিবিউন |
জাকিয়া আহমেদ: চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন রাজশাহীর বাসিন্দা। এরপর গত ২৩ জানুয়ারি একই হাসপাতালে এক শিশুর মৃত্যু হয় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। আর ফরিদপুরে মারা যাওয়া একজনের মৃত্যুর পর তার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর)। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত পাঁচজন নিপাহ ভাইরাসে শনাক্ত হবার কথা জানা গেছে।
নিপাহ ভাইরাসকে ‘মরণঘাতী’ আখ্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কোনো ওষুধ বা টিকা এখনো আবিষ্কার হয়নি। যার কারণে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা ৭০ থেকে ১০০ ভাগ। আর যারা বেঁচে থাকেন তাদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ স্নায়বিক দুর্বলতায় ভোগেন। তারা বলছেন, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের হার কম হলেও এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস মূলত ছড়ায় বাদুড়ের মাধ্যমে। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ সময়টায় খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর খেজুর গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বাদুড়। সে সময় বাদুড় হাঁড়িতে মল-মূত্র ত্যাগ করায় এবং রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যাওয়ায় ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। কাঁচা রস খেলে মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে এ ভাইরাস। বিশ্বে যেসব রোগ মহামারি আকার নিতে পারে তার একটি তালিকা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সে তালিকায় আছে নিপাহ ভাইরাসের নামও।
আইইডিসিআরের গবেষণা থেকে জানা যায়, শুধু কাঁচা রস পান করে নয় বরং ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীদের প্রায় অর্ধেক আক্রান্ত হয়েছে রোগীদের সেবা করার সময়।
এদিকে কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত নিপাহ ভাইরাস-বিষয়ক এক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি মারাত্মক মহামারির কারণ হয়ে উঠতে পারে।’
সম্মেলনের সহ-আয়োজক কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন্সের (সিইপিআই) প্রধান নির্বাহী রিচার্ড হ্যাচেট বলেছেন, ‘নিপাহ ভাইরাস শনাক্তের পর ২০ বছর কেটে গেছে। তবু এর বিপরীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি সামলানোর পর্যাপ্ত উপকরণ এখনো বিশ্বে নেই। এই ভাইরাসের প্রার্দুভাব এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ হলেও এটি মারাত্মক মহামারিতে রূপ নিতে পারে বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ বা পিএএনএসে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আগে যতটা ধারণা করা হয়েছিল নিপাহ ভাইরাস তারচেয়েও বেশি সংক্রামক। যেকোনো সময়, যেকোনো জনবসতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই নিপাহ ভাইরাস বাংলাদেশ, ভারত তথা এশিয়া অঞ্চলের আরেকটি মহামারির কারণ হতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, ২০০১ সালে প্রথম মেহেরপুরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৩ সালে শনাক্ত হয় নওগাঁয়। তবে পরের বছরই সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয় ফরিদপুর জেলায়। সেখানে শনাক্ত ৩৫ জনের মধ্যে মৃত্যু হয় ২৭ জনের। এরপরই আইইডিসিআর এ নিয়ে সার্ভিলেন্স কার্যক্রম শুরু করে।
আইইডিসিআরের হিসাবে, বাংলাদেশে গত ২৪ বছরে ৩৩টি জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে ৪১টি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ফরিদপুর জেলায়, ৭১ জন। ২০০১ সাল থেকে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ৩৩১ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে ২৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আইইডিসিআর জানায়, নিপাহ একটি জুনোটিক ভাইরাস (অর্থাৎ এটি প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়) এবং এটি দূষিত খাদ্য অথবা সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। টেরোপাস জেনাসের ফলখেকো বাদুড় এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক ধারক এবং বর্তমান সময়ে মহামারি সৃষ্টিকারী রোগের মধ্যে একটি হতে যাচ্ছে।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত খেজুরের রসের মাধ্যমেই এ রোগ ছড়াচ্ছে বলে দেখা গেছে। তাই শীতের সময় খেজুরের রস ও বাদুড়ে খাওয়া ফল এড়িয়ে যাবার অনুরোধ জানিয়ে তিনি আক্রান্ত রোগীকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রেও সাবধানতা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দেন। তিনি জানান, খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার পর নিপাহতে আক্রান্তের লক্ষণ দেখা যায় সাধারণ আট থেকে ৯ দিনের মধ্যে। অপরদিকে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসাদের লক্ষণ দেখা যায় ছয় থেকে ১১ দিনের মধ্যে।
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর কথা জানিয়ে ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, আইইডিসিআরের টিম মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। দেশে এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের একাধিক আউটব্রেক হয়েছে এবং চলতি বছরে দেশের কয়েক জায়গায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২০১১ সালে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় নির্দেশিকা জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশিকায় খেজুরের কাঁচা রসকে নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে সংক্রমণ রোধ করতে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম নিপাহকে বিপজ্জনক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এতে আক্রান্তের হার কম, কিন্তু ভাইরাসটি বিপজ্জনক। তাই প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধে জোর দিতে হবে।’