তাড়াশ উপজেলাসহ পাশের পাবনা, নাটোর ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার দই প্রস্তুতকারীরা মেলায় দইয়ের পসরা সাজিয়েছেন। উপজেলা সদরের দইমেলার মাঠে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

প্রতিনিধি তাড়াশ: কয়েক দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার কুয়াশার মাত্রা কিছুটা বেশি। আকাশে মেঘের আনাগোনা আছে। মাঘের এমন সকালে জমে উঠেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা সদরের দইমেলার মাঠ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজা উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী এই দইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এ বছর মেলার আয়োজন আরও জমজমাট বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।

বুধবার বিকেল থেকে বিভিন্ন এলাকার নামীদামি ঘোষদের দই আনার মধ্য দিয়ে প্রায় আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী তাড়াশের দইমেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। আজ সকাল নয়টার দিকে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, মেলায় বিভিন্ন জেলার দই কিনতে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার মানুষ ভিড় করছেন। দইয়ের পাশাপাশি ঝুড়ি, মুড়ি-মুড়কি, চিড়া, বাতাসা, কদমাসহ নানা ধরনের মিষ্টান্ন পাওয়া যাচ্ছে। সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলার আয়োজন করা হলেও মেলাটি এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

প্রতিবছর মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে উপজেলা সদরে এই দইমেলার আয়োজন করা হয়। দিনব্যাপী দইয়ের এই মেলা ঘিরে তাড়াশ উপজেলাসহ পাশের পাবনা, নাটোর ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলার দই প্রস্তুতকারীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ দেখা দেয়।
মেলায় দই কিনতে এসেছেন তাড়াশ বাজারের দর্জিদোকানের মালিক কার্তিক চন্দ্র সরকার বলেন, তাঁর বাপ-দাদার আমল থেকে পরিবারের লোকজন এই মেলায় আসেন। তাঁরা মেলা থেকে দইসহ বিভিন্ন খাবার কেনেন। তাই প্রতিবছরের মতো এবারও মেলায় এসেছেন তিনি।

সরস্বতী পূজা উপলক্ষে আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ছুটির দিনে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া এলাকা থেকে এসেছেন স্কুলশিক্ষক মো. রাকিবুল হাসান। তিনি বলেন, ‘শত বছরের পুরোনো ঐত্যিহ্যবাহী এই মেলায় এসে খুব ভালো লাগছে।’

মেলার আসা প্রবীণ দই প্রস্তুতকারীদের মধ্যে একজন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার শ্রীপুর এলাকার তানু কাজি। তিনি বলেন, ‘বয়স বেড়ে গেছে। এত দূর আসতে কষ্ট হয়। কিন্তু এই মেলার সময় এলে আর ভালো লাগে না। চলে আসতেই হয়। সবকিছুর দাম বাড়তি, তাই এবার দইয়ের দামও কিছুটা বেড়েছে।’

মেলায় বাহারি স্বাদের ও নামের দই পাওয়া যাচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বগুড়ার শেরপুরের উষা দইয়ের মালিক সন্তোষ কুমার ঘোষ বলেন, ঐত্যিবাহী এ মেলায় প্রতিবছরই আসা হয়। বেচা–কেনাও এবার ভালো।

চলনবিল অঞ্চলের তাড়াশের দইমেলা নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনি। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জমিদারি আমলে তাড়াশের সেই সময়ের জমিদার বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম দইমেলার প্রচলন করেছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, জমিদার বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর দই ও মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। তাই জমিদার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করতেন। আর সে থেকেই জমিদারবাড়ির সামনে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী দইমেলার প্রচলন।

সেই থেকে প্রতিবছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে দইমেলার শুরু হয়। কথিত আছে, প্রতিবছর মেলায় আগত সবচেয়ে ভালো সুস্বাদু দই তৈরিকারক ঘোষকে জমিদারের পক্ষ থেকে উপঢৌকন দেওয়ার রেওয়াজও ছিল। জমিদার আমল থেকে শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাহী তাড়াশের দইমেলা এখনো মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতেই উৎসব-আমেজে বার্ষিক রেওয়াজ মেনে চলে আসছে।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, সিরাজগঞ্জ’ শীর্ষক বইয়ে তাড়াশের এ দইমেলার বর্ণনা রয়েছে। বইটির প্রধান সম্পাদক শামসুজ্জামান খান বিস্তারিতভাবে এ মেলার বিবরণ দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, একসময় এ মেলায় ৭০০-৮০০ জন ঘোষ প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার মণ দই নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। তখন অবশ্য মেলা হতো তিন দিনের। বর্তমানে দিনব্যাপী মেলায় কয়েক শ মণ দই বিক্রি হয়।

দইমেলায় আসা এ অঞ্চলের দইয়ের স্বাদের কারণে নামেরও ভিন্নতা আছে। যেমন ক্ষীরসা দই, শাহী দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, টক দই, শ্রীপুরী দইসহ কত বাহারি নাম। নাম ও দামেও রয়েছে হেরফের। বিশেষ করে বগুড়ার শেরপুর, রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা, গুরুদাসপুরের শ্রীপুর, উল্লাপাড়ার ধরইল, চাটমোহরের হান্ডিয়াল ও তাড়াশের দই প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন এলাকার পাঁচজন ঘোষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুধের দাম, জ্বালানি ও শ্রমিকের খরচ, দইয়ের পাত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দইয়ের দামও বেড়েছে। তবে বার্ষিক এ মেলায় আসতে পেরে তাঁরা খুশি।

তাড়াশ উপজেলা সনাতন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও তাড়াশ প্রেসক্লাবের সভাপতি সনাতন দাশ বলেন, ঐতিহ্য মেনে সরস্বতী পূজার দিনে তাড়াশে দইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সুষ্ঠু পরিবেশে এ মেলা সম্পন্ন করতে দলমত-নির্বিশেষে সবাই কাজ করেন। দইয়ের পাশাপাশি এ মেলায় নানা পদের মিষ্টান্নও পাওয়া যায়।