নদী থেকে নেট জাল টেনে বাগদা বা গলদা চিংড়ি রেণু আহরণ করছেন উপকূলের নারীরা। সম্প্রতি সুন্দরবনসংলগ্ন দাকোপ উপজেলার কালাবগি এলাকায় শিবসা নদীতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি খুলনা: শহিদুল গাজীর বয়স ৫০ বছর। বসবাস করতেন সুন্দরবনসংলগ্ন দাকোপ উপজেলার কালাবগি এলাকার ঝুলন্তপাড়ায়। বনের ওপর নির্ভর করেই ছিল তার জীবিকা। চার বছর আগে একদিন রাতে বন থেকে বাসায় ফিরে বিছানায় পড়ে আর উঠতে পারেননি। এখন তার শরীরের ডান পাশের অংশ (মাথা থেকে পা পর্যন্ত) অবশ হয়ে আছে। কোনো চিকিৎসাতেই তিনি সেরে উঠতে পারেননি।
তার ছেলে জাহাঙ্গীর গাজী বলেন, ‘বাবাকে আমরা অনেক চিকিৎসক দেখিয়েছি। তারা বলেছেন, উচ্চ রক্তচাপের কারণে বাবা স্ট্রোক করেছেন।’
একই এলাকার ২৬ বছর বয়সী এক নারীর বিয়ে হয়েছে ৮ বছর আগে। এ পর্যন্ত তার কোনো সন্তান হয়নি। ওই নারী বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমার ৩ বার অকাল গর্ভপাত হয়েছে। পেটে বাচ্চার বয়স ৪ থেকে ৫ মাস হলেই সমস্যা দেখা দেয়। পরে সেই বাচ্চা আর বাঁচে না।’
ওই নারী বলেন, ‘শুধু আমারই যে এমনটি হচ্ছে তা নয়। আমার পরিচিত অনেকেরই এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। আগে আমি গর্ভাবস্থা শুরুর দিকে নদী থেকে নেট জাল টেনে রেণু আহরণ করেছি। নিয়মিত লবণপানি ব্যবহার করেছি। তবে এখন আমি বাড়তি সতর্কতা নিয়েছি। ভবিষ্যতে হয়তো আমার গর্ভপাত হবে না।’
সুন্দরবনসংলগ্ন ওই গ্রামটি শিবসা ও সুতারখালী নদীর মোহনায় অবস্থিত। নদী ও সুন্দরবনের লবণপানির সঙ্গেই তাদের জীবনযাপন।
এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের শরীর থাকে জরাজীর্ণ। মাথার চুল আঠালো, চোখ চালছে ও শরীরের ত্বক রুক্ষ ও শুষ্ক।
সালাহউদ্দীন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘ছোট ছেলে-মেয়েরা প্রায় সময় পানিতে কাটায়। নদী থেকে বাগদা ও গলদার রেণু আহরণ করার জন্য নেট জাল টানতে তারা প্রতিদিনই ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পানিতে থাকে। লবণপানিতে বেশি সময় থাকায় তাদের চেহারা পাল্টে যায়। তাদের মাথার চুল আঠালো, শুষ্ক ত্বক ও জীর্ণশীর্ণ দেহের মূল কারণ হলো লবণপানিতে বেশি সময় থাকা।’
শিরিনা নামের আরেক নারী বলেন, ‘১৩ থেকে ১৪ বছর বয়স হলেই আমরা মেয়েদের নেট জাল টানতে নদীতে নামতে দেই না। কারণ এই বয়সে লবণপানিতে বেশি সময় কাটালে তাদের যৌন সম্পৃক্ত রোগ বেড়ে যায়। অনিয়মিত মাসিক ও শরীরের চামড়া গাঢ় কালছে হতে থাকে। তাই ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সেই বাবা মায়েরা মেয়ে শিশুকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ওই বয়সেই উপকূলের মেয়েদের বেশি বিয়ে দেয়া হয়। অল্প বয়সেই মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক ও যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কারণে তাদের দ্রুত বিয়ে দিতে হয়।’
খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনাঞ্চলের উপকূলে অকাল গর্ভপাত, পেটের নানা জাতীয় রোগ, ত্বকের রোগ ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীর পরিমাণ অনেক বেশি। সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, ‘উপকূলের মানুষের রোগের ধরন ও অন্য এলাকার রোগের ধরন আলাদা। সেখানে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া, চোখের উপরিভাগের রোগ, আলসার, চর্মরোগ, দাঁত, চুল, নখসহ এ জাতীয় রোগ বেশি হয়। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকার তুলনায় অকাল গর্ভপাত ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীর পরিমাণও অনেক বেশি। এতে কারও কারও হার্ট, কিডনি ও ব্রেইনে জটিল রোগ বাসা বাঁধছে।’
তিনি বলেন, ‘উপকূলের মানুষ বেশিমাত্রায় লবণাক্ত পানি পান করেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজেই লবণপানি ব্যবহার করেন। আর সুন্দরবনের জেলেরা তো লবণপানির সঙ্গেই বসবাস করেন। খাবার পানির মাধ্যমে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার জন্য তাদের এসব অসংক্রামক রোগ বেশি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লবণকে বলি হোয়াইট (সাদা) কিলার। এটিতে সোডিয়াম ও ক্লোরাইডের রাসায়নিক মিশ্রণ থাকে, যা শরীরে প্রবেশ করার পর রক্তের চাপ বৃদ্ধি করে। রক্তের চাপ বেশি হলে শরীরের হার্ট, ব্রেইন ও কিডনিতে জটিলতা শুরু হয়।’
সিভিল সার্জন বলেন, ‘উপকূলে অধিক লবণাক্ততার কারণে সেখানে ফসল ফলে না, ফলমূলের কোনো গাছ নেই। যে কারণে সেখানের মানুষ পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হন। বলা যায়, অধিক লবণাক্ততার কারণে উপকূলে পুষ্টিহীনতা বেড়েছে। এটিও রোগ বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ।’
অকাল গর্ভপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গর্ভবতী মায়েদের লবণপানি খেতে হয় ও ব্যবহার করতে হয়। লবণ বেশি খাওয়ার জন্য উচ্চ রক্তচাপে তাদের গর্ভপাত হয়। এ ছাড়া যৌনাঙ্গে লবণপানি ব্যবহারের ক্ষতি তো আছেই।’
তিনি বলেন, ‘উপকূলে অধিক লবণাক্ততার কারণে অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
খাবার পানি অতিমাত্রায় লবণাক্ত
২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে খুলনাঞ্চলের উপকূলীয় মানুষের নিরাপদ খাবার পানির দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় বসবাসকারী ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ওই জরিপের তথ্য মতে, উপকূলীয় এসব উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাবার পানিতে ১ হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে হাজার ২৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা রয়েছে। তবে পানির প্রতি লিটারে ১ হাজার মিলিগ্রামের বেশি লবণাক্ততা থাকলে তা খাওয়ার অনুপযোগী।
সেখানকার মানুষ পান করেন এমন ৫২ শতাংশ পুকুর ও ৭৭ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে অনুমোদিত মাত্রার থেকে বেশি মাত্রায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। দাকোপ উপজেলার পুকুরগুলোতে ৬৫০ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ২৪ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫৮১ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ১ হাজার ২০৩ মিলিগ্রাম, ও শ্যামনগরে ১ হাজার ১৮৪ মিলিগ্রাম লবণাক্ততা পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া টিউবওয়েলগুলোর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা রয়েছে দাকোপে ২ হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম, কয়রায় ১ হাজার ৪৫৩ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫১০ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ৯৯৮ মিলিগ্রাম ও শ্যামনগরে ১ হাজার ৬৮৩ মিলিগ্রাম।
এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে বা শীতকালে শ্যামনগর উপজেলার টিউবওয়েলে প্রতি লিটার পানিতে ৬ হাজার ৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পওয়া গেছে, যা অনুমোদিত সীমার চেয়ে ৬ গুণেরও বেশি।
গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত ওই জরিপ প্রকল্পের সমন্বয়কারী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘প্রায় তিন দশক ধরে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে। ওই এলাকার মানুষ খাবার পানির জন্য মূলত পুকুর ও টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। কিছু এলাকায় লবণপানির চিংড়ি চাষের কারণে সুপেয় পানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণেও অনেক পুকুর লোনাপানিতে ভরে গেছে। পরে তা সংস্কার করা হয়নি।’