জাতির সূর্যসন্তানদের হারানোর দিন আজ

ঢাকার রায়েরবাজারে ইটখোলায় পড়ে ছিল বহু বুদ্ধিজীবীর ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ, বিজয়ের পর ছবিটি তোলেন ভারতীয় ফটোসাংবাদিক কিশোর পারেখ 

প্রতিবেদক, পদ্মা ট্রিবিউন: বিজয়ের আনন্দ উদযাপনে উন্মুখ এক জাতিকে অশ্রুজলে ভাসানোর দিন আজ। স্বাধীনতার লাল সূর্য আনতে গিয়ে দেশের সূর্যসন্তানদের হারিয়ে ফেলার দিন এটি। একাত্তরের ডিসেম্বরের মধ্যভাগে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় যখন অনিবার্য, তখন পাকিস্তানি হানাদারদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে বাংলাদেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের। উদ্দেশ্য ছিল পুরো জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া, যাতে করে দেশটি আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

প্রায় অর্ধশতক পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে সরকার ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জনের একটি তালিকা করে।

বুদ্ধিজীবী হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা এবং যুদ্ধাহত ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৭টা ২২ মিনিটে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সর্বস্তরের জনগণ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

দিবসটি উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ছিল জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে বলে আমি মনে করি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালি জাতির বিজয়ের প্রাক্কালে তারা দেশের মেধাবী সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা ও গুম করে। তাদের মধ্যে ছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, শহীদুল্লা কায়সার, গিয়াসউদ্দিন, ডা. ফজলে রাব্বি, আবদুল আলীম চৌধুরীসহ অনেকে। স্বাধীনতাবিরোধীরা এই পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পরাজয়ের জঘন্যতম প্রতিশোধ নেয়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনেছে। বিচার চলমান রয়েছে এবং অনেক বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। এসব রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পেয়েছে। দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে। এই কুখ্যাত মানবতাবিরোধীদের যারা লালন-পালন ও রক্ষার চেষ্টা করছে, তাদেরও একদিন বিচার হবে, ইন্শাআল্লাহ।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ৭১-এর ঘাতক, মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-মৌলবাদী চক্র এবং গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির যেকোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করে দেশের অগ্রযাত্রা এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান সরকারপ্রধান।

দিবসটি উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। দিবসটি উপলক্ষে সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে। দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কালো পতাকা উত্তোলন, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। এ ছাড়া বেলা ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে আলোচনা সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিএনপির কর্মসূচির মধ্যে আছে ভোরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৮টায় কালো ব্যাজ ধারণ ও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে দলের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। বেলা ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আলোচনা সভা হবে দলটির।