মাছের দোকানগুলোয় থরে ধরে সাজানো আছে বড় বড় রুই, কাতলা, চিতলসহ বিভিন্ন জাতের দেশি মাছ। শুক্রবার সকালে শিবগঞ্জ উপজেলার উথলি মেলায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি বগুড়া: হেমন্তের শিশিরভেজা সকাল। ভোরের সোনালি আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে কৃষকের আমন ধানের শিষে। এমন সাতসকালেই ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক আর বেচাবিক্রিতে জমে উঠেছে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলি মেলা। গ্রামবাংলার চিরায়ত উৎসব নবান্নকে কেন্দ্র করে বসেছে এই মেলা।
মেলার মূল আকর্ষণ পুকুর, খাল-বিল আর নদ-নদীর বড় মাছ। তবে মাছের পাশাপাশি শিশুদের খেলনা, নারীদের প্রসাধনী, অলংকার, হরেক রকম শাকসবজি, মিষ্টান্নসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার পাওয়া যাচ্ছে এক দিনের এই মেলায়।
স্থানীয় লোকজনের মতে, সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে এই মেলা শুরু হয়। প্রায় দেড় শ বছর ধরে এই মেলা চলে আসছে। এ সময় গ্রামের ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। বেশির ভাগ বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ অন্য আত্মীয়স্বজনেরা এ সময় বেড়াতে আসেন। সব মিলিয়ে মেলার সময় উথলি ছাড়া আশপাশের গ্রামগুলোতেও উৎসবের আমেজ দেখা যায়।
আজ শুক্রবার সকালে মেলা ঘুরে দেখা গেল, মাইকে হাঁকডাক দিয়ে মাছের ক্রেতাদের আকর্ষণ করছেন বিক্রেতারা। দোকানগুলোয় থরে ধরে সাজানো আছে বড় বড় রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, বোয়ালসহ বিভিন্ন জাতের দেশি মাছ। পছন্দের মাছটি কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা মেলায় ভিড় করেছেন। শিবগঞ্জ ছাড়া বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতারাও মেলায় মাছ কিনতে এসেছেন।
১০ হাজার টাকায় ১০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ কিনেছেন শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক বাজারের শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, শৌখিন মাছ কেনার জন্য প্রতিবছর তিনি মেলায় আসেন। তবে এবার মাছের দাম অনেক বেশি।
মাছ বিক্রেতা মোখলেছার ইসলাম গাইবান্ধা থেকে মাছ বিক্রির জন্য মেলায় এসেছেন। সকাল থেকে তিনি ২২ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। মোখলেছারের মতো আরও অনেকেই দূর–দূরান্ত থেকে মাছ বিক্রি করতে এসেছেন। আরেক মাছ বিক্রেতা নিবারণ চন্দ্র বলেন, বড় আকারের কাতলা প্রতি কেজি এক হাজার টাকা ও রুই ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বিগহেড প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, সিলভার কার্প ৪৫০, মৃগেল ৪০০, পাঙাশ ৩০০ টাকা দরে পাওয়া যাচ্ছে। মাঝারি আকারের রুই ও কাতলার দর হাঁকানো হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
পছন্দের মাছটি কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা মেলায় ভিড় করেছেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মেলার ইজারাদার আজিজুল হক বলেন, ছোট-বড় সব মিলিয়ে মেলায় শতাধিক দোকান বসেছে। ভোররাত থেকে বেচাবিক্রি চলছে। এক দিনের এই মেলায় প্রায় প্রতিটি দোকানে গড়ে ১০ মণ মাছের আমদানি হয়েছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য নবান্ন আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ নতুন আলু, মিষ্টি আলু, খেতের শাকসবজি, কেশুর ও পানিফল। মেলায় এসব অনুষঙ্গেরও পসরা সাজিয়েছেন বিক্রেতারা। প্রতি কেজি নতুন আলু এখানে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিষ্টি আলু ও কেশুর বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি দরে। মেলায় বসেছে দই, চিড়া, মুড়ি–মুড়কি, কদমা, বাতাসা, নিমকি, জিলাপিসহ হরেক রকম মিষ্টান্নের দোকান। শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে নাগরদোলা আর খেলনার দোকান। মেলায় নারীদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। তাঁরা মূলত ভিড় করেছেন আলতা-চুড়ির দোকানে।
নারায়ণপুর গ্রামের সত্যেন্দ্রনাথ সাহা বলেন, প্রায় দেড় শ বছর ধরে নবান্ন উৎসবকে ঘিরে উথলি গ্রামে এই মেলা বসছে। মেলা থেকে কেনা মাছ আর নতুন আলুর তরকারির সঙ্গে নতুন চালের ক্ষীর ও পায়েস দিয়ে এই এলাকার মানুষ নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করে। কালের বিবর্তনে জৌলুস হারালেও এখনো এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অন্যতম বড় উৎসব এই মেলা। নদীর বড় বড় মাছের জন্য আশপাশের জেলাগুলোয়ও এই মেলার খ্যাতি আছে। তবে এখন নদীর মাছের চেয়ে পুকুর ও খাল-বিলে চাষ করা বড় মাছের অধিক্য বেশি।
উথলি ছাড়া নবান্ন উপলক্ষে আজ সকাল থেকে বগুড়ার মহাস্থানহাট, কাহালু, দুপচাঁচিয়া ও নন্দীগ্রাম উপজেলা সদরে মাছের মেলা বসেছে।