সোনালি ধান গরুর গাড়িতে তুলে বাড়ির পথে কৃষক। ছবিটি সম্প্রতি উপজেলার গড়গড়ি গ্রাম থেকে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

মিতু মরিয়ম, ঈশ্বরদী: কুয়াশা ভেদ করে যখন সূর্যের আলো প্রকৃতিতে আসে, তখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে দিগন্তবিস্তৃত আমনের খেত। সোনামাখা রোদে মাঠে মাঠে ঝলমলিয়ে ওঠে সোনালি ধান। সেই ধানের ঝিলিক যেন ছড়িয়ে পড়েছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার কৃষকদের চোখেমুখে।

প্রকৃতিতে এখন হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই মাঠে মাঠে সোনালি ধানের হাসি আর নবান্নের উৎসব। আমন ধান ঘরে এলেই গ্রামবাংলার কৃষকদের চিরায়ত এক উৎসবের নাম নবান্ন। অগ্রহায়ণ মাসে ঘরে প্রথম ধান তোলার পর নতুন চাল দিয়ে উৎসবটি পালন করেন কৃষিজীবীরা।  

এখন পাকা ধান ঘরে তুলছে চাষি। কিষান-কিষানি ব্যস্ত ধান প্রক্রিয়াকরণ কাজে। ধান কুলায় তুলে বাতাসে উড়িয়ে কৃষানি বের করছে খাদ্যপ্রাণ। স্থানীয় এই প্রক্রিয়াকে বলে ধান ঝাড়া বা ধান ওড়ানো। উপজেলার চরকুড়ুলিয়া গ্রাম থেকে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

উপজেলার শেখেরদাইড় কোলেরকান্দি, জগন্নাথপুর, চরমিরকামারী পূর্বপাড়া, মাথালপাড়া, দিয়াড় বাঘইল, নলগাড়ী, চররূপপুর, শেখপাড়াম, শ্রীপুরম আব্দুল্লাপুর, চাদঁপুর, বালিয়াডাংঙ্গা, চকনারিচা বাগবাড়ীয়া, রামচন্দ্রপুর, কালামপুর, কালামপুর পূর্ব পাড়া, চরকুড়ুলিয়া, বরমপুর, লক্ষীকুন্ডা, গাঁওগোয়াইল, দিয়াড়সাহাপুর, তিলকপুর, দীঘা, গড়গড়ির বিভিন্ন এলাকার মাঠে মাঠে চলছে ধান কাটা। গানে গানে ধান কেটে চলছেন কৃষকেরা। রামচন্দ্রপুর এলাকার কৃষক গোলাম হোসেন (৪২) এবার দুই একর জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। এখন জমির সেই ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। তিনি বললেন, ‘ধানের ফলন ভালো হইচে। দামও ভালো পাইছু। আমার আর কী লাগে?’

একই গ্রামের আরেক কৃষক সনাতন রায় (৪২) দুই বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন। ফলনের ব্যাপারে তিনি বলেন, খরচ আর ধানের দাম মিলিয়ে এবার মোটামুটি লাভ হবে। ধান উঠলে যেই টাকা হাতে পাবেন, সেটা দিয়ে আবার আলু লাগাবেন তিনি।

আমন ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েক ব্যক্তি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

খেত থেকে ধান কেটে আনার পর কৃষকেরা বাড়ির উঠানে মাড়াই করছেন। ধানের ম-ম গন্ধ এখন কৃষকের উঠানজুড়ে। কোথাও কোথাও বাড়ির গৃহিণীরা সামগাইনে (কাঠের তৈরি ধান-চাল গুঁড়া করার যন্ত্রবিশেষ) নতুন ধানের চাল গুঁড়া করছেন। চালের সেই গুঁড়ায় তৈরি হবে নানা রকমের সুস্বাদু পিঠা-পায়েস।

দিনভর গতর খাঁটিয়ে কৃষক বসে যাবেন বাড়ীর ওঠোনের এক কোণে। ভেতর থেকে ততক্ষণ বাতাসে পিঠা পায়েসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়বে। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা পিঠাপুলির স্বাদ উপভোগ করবে। অগ্রহায়ণ এলেই এ যেন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক পরিবারের এটাই নবান্নের চিত্র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামে নুরুল ইসলামের বাড়িতে দেখা গেল, সামগাইনে চাল গুঁড়া করার ব্যস্ততা। কাজের ফাঁকে নুরুলের স্ত্রী রেবেকা মমিন বললেন, ‘নতুন ধানের পিঠা-পায়েস না খাইলে কী হয়? ছোট থেকেই নতুন ধানের চালের পিঠা খেয়ে আসছি। এই চালের গুঁড়া দিয়ে ভাপা, চিতই, গুরগুরিয়া, সেমাই, তেলপিঠাসহ কত পিঠা হবে!’

ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকেরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

নুরুল ইসলামের বাড়িতে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকেও চাল গুঁড়া করার শব্দ ভেসে এল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, শফিকুলের স্ত্রী রওশন আরা চাল গুঁড়া করছেন। এ সময় রওশন আরা বলেন, ‘নতুন ধান উঠলেই সেই ধানে চাল করে গুঁড়া করি। নিজেদের গুঁড়া করা চালে তৈরি পিঠা অনেক মজা হয়। পিঠা বানানোর দিন আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা বাড়িতে আসেন। সবাই একসঙ্গে বসে পিঠা বানাই।’

নবান্ন উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন ধান তোলার এই আনন্দ সবাই একসঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া। গ্রামবাংলার কৃষকদের এই আয়োজনকে অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব বলে মনে করেন সমাজ-গবেষক ও স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা। তবে কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে নবান্ন উৎসবের পরিসর অনেকাংশে কমে গেছে।

পাকা ধানের গন্ধে ম-ম করছে পুরো এলাকা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ও সহকারি অধ্যাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কৃষকেরা এই সময় নানা জাতের ধান আবাদ করতেন। আর সেই ধানে কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে নতুন চালের ভাতের সঙ্গে পিঠা-পুলির উৎসব হতো। কিন্তু এখন আগের মতো সেই উৎসব খুব একটা দেখা যায় না।’

ধান কেটে বাড়িতে এনে বাড়ির উঠানে মেশিনে মাড়াইয়ের কাজ সেরে নিচ্ছেন কৃষক | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিউ এরা ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক ও ঈশ্বরদী প্রেসক্লাবের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, একসময় আড়ম্বরপূর্ণভাবে নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হতো। সব ধর্মের মানুষের জন্য অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব হিসেবে সারা দেশেই নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিল। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে এ উৎসব উদ্যাপন করা হতো। তবে এখন মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন কমে গেছে। জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে নবান্ন উৎসবের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে যদি তৃণমূল পর্যায়েও বড় পরিসরে উৎসব আয়োজন করা যেত, তাহলে এই ঐতিহ্য দীর্ঘদিন টিকে থাকত।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঈশ্বরদী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় এবার ৩ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে আমন ধান আবাদ হয়েছে। এই পরিমাণ জমি থেকে বিঘা প্রতি ফলন ২০ থেকে ২২ মন চাল উৎপাদিত হবে।