আজমির শরিফে একবেলা

আজমীর শরীফ দরগাহ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রিয়াদ ইসলাম, রাজস্থান থেকে ফিরে: ঘড়ির কাঁটা ভোর সাড়ে নয়টায়। ট্রেন থেকে নামলাম সবে। আজমির জংশন থেকে রিকশায় চড়ে হাজির হলাম দরগাহ সড়ক। দরবারের কিছুটা দূরে নামিয়ে দিল চালক। সামনের পথ হাঁটার।

সকাল হতে না হতেই প্রচণ্ড ভিড়। ওই তো দেখা যাচ্ছে আজমির শরিফের প্রধান ফটক। সুফিধারার অন্যতম একটি ‘চিশতিয়া সিলসিলা’। যার সাধক হলেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.)। আজমির শরিফ মূলত তারই রওজা শরিফ।

প্রধান গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে পা রাখলাম। নজরে পড়ল একের পর এক ফটক। প্রতিটার সামনে বাহারি কারসাজি। প্রধান ফটক পেরোতেই ফুলে সাজানো ছোট্ট ছোট্ট মোড়ক দেখলাম। দ্বিতীয় ফটকে পা রাখতেই দেখলাম দুটি উঁচু জায়গা। প্রচুর লোকের ভিড় যেখানে। এগিয়ে যেতেই ধরা পড়ল একটি রহস্য। ছোটা দ্যাগ, বড়া দ্যাগ নামে দুটো বড় ডেকচি পোঁতা মাটিতে। খাজার নামে সবাই তাতে পাঁচশত, হাজার রুপির নোট রেখে দিচ্ছে।

বাঁ-পাশে নজরে পড়ল সুবিশাল মসজিদ। সেখানে কয়েকজন লোক তালিম দিচ্ছে বাচ্চাদের। এগোলাম ডানপাশে। চোখ আটকালো আড়াইশত হুজরায়। যার প্রতিটায় রয়েছে লাল-সবুজ রঙের পোশাক পরিহিত ভদ্রলোক। যাদের কাজ কেবল হজরতের নামে উর্দু-হিন্দিতে বিভিন্ন ছন্দ মেলানো। সুর করা। গান গাওয়া। এতেই লাখো রুপি কামাই প্রতি মুহূর্তে।

এগোলাম তৃতীয় ফটকে। পাশেই একটি পাথরে বাঁধা হাউজ। তাতে রাখা গোলাপজল। নারী-পুরুষ হাত-মুখ ধুচ্ছে অবাধে। কিছু লোক চামড়ার মশকে শুদ্ধজল বলে পানি বিক্রি করছে চড়া দামে।

পা বাড়ালাম চতুর্থ ফটকে। কিছু লোক ঢোল-তবলা বাজাচ্ছে হরদম। সামনেই হজরতের কবরের মূল গেট। হাতের ইশারায় একজন দেখিয়ে দিল ভেতরে যাওয়ার সারি। দাঁড়ালাম দীর্ঘ লাইনে। মিনিট দশেকের মতো ঠেলাঠেলি হলো। এরপর পৌঁছালাম ভেতরে। সামনের ভদ্রলোকের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ দিল সংশ্লিষ্ট এক বাবা। কবরের চারপাশে প্রায় জনত্রিশেক বাবাকে ব্যস্ত দেখা গেল ঝাড়ফুঁকে। 

পা বাড়ালাম অন্য ফটকে। একটি বিশাল গাছ দেখলাম বাইরে বেরিয়ে। কিছু লোককে দেখলাম ভাটিয়ালির আদলে খাজার সুর ধরেছে। অবাক হলাম সামনে এগোতেই। নর-নারী, হিন্দু-মুসলিমকে দেখলাম মাজার বরাবর সেজদা করছে। হু-হু শব্দে রোনাজারি করছে বাবার দরবারে। ফুল ছড়াচ্ছে বড় আবেগে। লাল সুতা হাতে পরেছে সব বয়সি উপস্থিতরা। আজমির শরিফকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নামিদামি হোটেল, দোকান।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) ৫৩৬ হিজরি মোতাবেক ১১৪১ খ্রিষ্টাব্দে ইমাম গাজালির মৃত্যুর ৩১ বছর পর পূর্ব পারস্যের সিজিস্তান প্রদেশের সানজা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনিই উপমহাদেশে প্রথম চিশতিয়া ধারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেন। পরে তার অনুসারীরা সুফি ধারা এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) পারস্যে বেড়ে ওঠেন। পনেরো বছর বয়সে তার পিতামাতা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার পিতার কাছ থেকে একটি বাতচক্র ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। একদিন তিনি তার ফলবাগানে পানি দিচ্ছিলেন, তখন সেখানে বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজি (রহ.) আসেন। তিনি কুন্দুজি (রহ.)-কে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজি (রহ.) তাকে এক টুকরো রুটি দেন ও তা খেতে বলেন। এরপর তিনি তার সব অর্থ-সম্পত্তি গরিবদের মাঝে বিতরণ করে দেন। এ কারণেই তাকে ‘গরিবে নেওয়াজ’ বলা হয়।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চশিক্ষার জন্য বোখারার উদ্দেশে যাত্রা করেন। বোখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। সেখানে চিশতিয়া তরিকার অপর প্রসিদ্ধ সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনি (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে খাজা উসমান হারুনি (রহ.) তাকে খেলাফত দান করেন।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত, দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি সাধকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ইরাকের বাগদাদে বড় পির আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। এ সময় আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) তাকে বলেন, ‘ইরাকের দায়িত্ব শায়খ শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্তানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো।’ একই সংবাদ নিজ পির খাজা উসমান হারুনি (রহ.)-এর সঙ্গে মদিনায় অবস্থান ও জেয়ারতকালে রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে পান। তিনি আরব থেকে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর, পরে দিল্লি হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) ছিলেন পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বীয় পির উসমান হারুনি (রহ.)-এর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাখি (রহ.)-সহ শতাধিক মুরিদানকে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।

অবশেষে ৬৩৩ হিজরির ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় তিনি ইন্তেকাল করেন। সময় তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তার বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দীন চিশতি (রহ.) তার জানাজার ইমামতি করেন। যেই কক্ষে তিনি ইন্তেকাল করেন, সেখানেই তাকে চির সমাহিত করা হয়।

প্রতি বছর ১ রজব থেকে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরিফে তার সমাধিস্থলে বার্ষিক ওরস শরিফ অনুষ্ঠিত হয়। যাতে নানা ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সমবেত হন।

আজমীর শরীফ দরগাহ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন