স্টেশন-ট্রেনজুড়ে তাঁদের প্রেমের গল্প, তাই সেখানেই বিয়ের ফটোশুট

প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে ট্রেন। চলন্ত ট্রেনের দরজা থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমির হামজা। ছুটে এসে ভালোবাসার মানুষের সেই হাত ধরার চেষ্টা ফাতেমা তুজ জোহরার। এমনই একটি দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাঁদের বিয়ের ফটোশুটে | ছবি: ফাতেমা তুজ জোহরার কাছ থেকে পাওয়া

মানসুরা হোসাইন: ফাতেমা তুজ জোহরা ও আমির হামজা দম্পতি বিয়ের ফটোশুট করেছিলেন সিলেট রেলস্টেশনে, পারাবত এক্সপ্রেসে। এ ঘটনা গত এপ্রিলের। সম্প্রতি ট্রেন বা রেলওয়ে নিয়ে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে তাঁদের ওই ফটোশুটের ছবিগুলো আলোচনায় এসেছে। ফাতেমা তুজ জোহরা জানান, তাঁদের মধ্যে যখন প্রেমের সম্পর্ক ছিল, তখন বেশির ভাগ সময় কথা হতো স্টেশনে বসে। আমির হামজা আগে ট্রেনে চড়তেন। তারপর হাত ধরে ফাতেমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে নেমে যেতেন। সেসব স্মৃতি ধরে রাখতেই বিয়ের ফটোশুটের জন্য স্টেশন ও ট্রেন বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা।

পরিচয়ের পরপর স্বামীর আগের প্রেমিকাকে আবার ফিরে আসার জন্য স্টেশনে বসেই ফোন করেছিলাম। শুরুতে আমি চেয়েছিলাম, তাঁদের দুজনকে এক করে দিতে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি’

আমির হামজার বাড়ি সিলেটে। ফাতেমা তুজ জোহরা ঢাকার মেয়ে। ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন ফাতেমা। পরে চাকরিসূত্রে সিলেটে যান তিনি। শমশেরনগরে মামার বাসায় থাকতেন। কাজ শেষে রাতে ট্রেনে করে সেখানে ফিরতেন। ফাতেমাকে রাতের ট্রেনে তুলে দেওয়া পর্যন্ত আমির হামজা তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। কেননা তত দিনে ফাতেমা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, সেখানেই চাকরি পান আমির হামজা।

স্টেশনে ট্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেমা-আমির হামজা। সঙ্গে লাগেজ। যেন এখনই ট্রেনে উঠে পাড়ি দেবেন ভালোবাসাঘেরা বাকিটা জীবন | ছবি: ফাতেমা তুজ জোহরার কাছ থেকে পাওয়া

প্রেমের স্মৃতি ধরে রাখতে
ফাতেমা এখন সিলেটে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। আপাতত চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। কেননা, প্রেম করা অবস্থাতেই তাঁকে সিলেট থেকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছিল। আর আমির হামজা সিলেটে তাঁর বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছেন।

এপ্রিলে তোলা বিয়ের ছবি ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে কথা হয় ফাতেমা তুজ জোহরার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেখলাম রেলওয়ে ও ট্রেনসংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রুপে আমাদের বিয়ের ছবিগুলো আবার আলোচনায় এসেছে। কেউ হয়তো নতুন করে সেগুলো পোস্ট করেছেন বা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। আমরা আসলে আলোচনায় আসার জন্য এ ফটোশুট করিনি। ফেসবুকেও ছবিগুলো সেভাবে দেওয়ার সুযোগ পাইনি। যারা (চন্দ্রবিন্দু) ফটোশুট করেছিল, তারা কিছু ছবি ফেসবুকে দিয়েছিল। তবে তখন সেগুলো তেমন আলোচনায় আসেনি।’

ফাতেমা বললেন, ‘আমরা আমাদের প্রিয় সময়ের স্মৃতি ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। আর ঢাকা থেকে সিলেট এবং সিলেট থেকে শমশেরনগর ফেরার সময় ট্রেনেই যাতায়াত করতাম বলে পাহাড়িকা আর পারাবত ট্রেনের গার্ড থেকে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরাও প্রায় দেখতেন, একটি মেয়ে আর একটি ছেলে শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরার জন্য প্ল্যাটফর্মে দৌড়াচ্ছেন। ট্রেন ছাড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের দুজনের গল্পেই সময় কেটে যেত। এমনও হয়েছে রাত নয়টার ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। কিন্তু তা বাতিল করে আবার ১০টার ট্রেনের টিকিট কাটা হতো। বিয়ের ফটোশুটের সময় ট্রেনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন।’

স্টেশনে শুরু প্রেম যেন বিয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে স্টেশনেই | ছবি: ফাতেমা তুজ জোহরার কাছ থেকে

প্রেম থেকে বিয়ে—এ পর্যন্ত আসতে তাঁদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বলে জানালেন ফাতেমা। বললেন, আমির হামজার পরিবার প্রথমেই তাঁদের সম্পর্ক নাকচ করে দেয়। কারণ, মেয়ে সিলেটের বাসিন্দা নয়। আমির হামজার মা রাজি থাকলেও, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা প্রথমে রাজি ছিলেন না। ফলে ২০২০ সালে তাঁরা ঢাকায় কাজি অফিসে গিয়ে গোপনে বিয়ে করেছিলেন।

বিয়ের পর ফাতেমা ইচ্ছা করেই তাঁদের বিয়ের একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। তা থেকে বিয়ের বিষয়টি জানাজানি হলে আরেক দফায় সমস্যা শুরু হয়। ফাতেমা বলেন, ‘সব সামলিয়ে অবশেষে দুই পরিবারের সম্মতিতে আবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয় তাঁদের। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নবদম্পতি বর-কনে সেজে ছোটেন স্টেশনে ফটোশুটের জন্য।’

প্রেম, বিয়ে ও আত্মহত্যাকে ‘না’ বলার গল্প
ফাতেমা-আমির হামজা দম্পতির প্রেম নিয়ে আছে ভিন্ন আরেকটি গল্পও। ফাতেমা বলেন, ঢাকায় থাকার সময় ফেসবুকে একটি গ্রুপের মাধ্যমে আমির হামজার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। পরিচয়ের কিছুদিন পর তিনি জানতে পারেন, আমির হামজা আত্মহত্যা করবেন বলে পরিকল্পনা করে রেখেছেন। ফাতেমা সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মানসিক যেকোনো টানাপোড়েনে পরিবারের সদস্যসহ অন্যদের পরামর্শ দিতেন। তাই আমির হামজা কেন আত্মহত্যা করতে চান, তা জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন ফাতেমা। 

ফাতেমার সঙ্গে আমির হামজার পরিচয় হয় ২০১৮ সালের শুরুর দিকে। সে বছরের ২৯ এপ্রিল আমির হামজা আত্মহত্যা করবেন বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন।

ফাতেমার ভাষ্যমতে, আমির হামজার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে একটি মেয়ের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরিবার রাজি না থাকায় সেই সম্পর্কে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হয়। মেয়েটি অন্য একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ে। আমির হামজা তা মেনে নিতে পারেননি। এ কারণেই তিনি আত্মহত্যার দিনক্ষণ জানিয়েছিলেন ফাতেমাকে।

এই স্টেশনেই কত শত গল্প রয়েছে ফাতেমা-আমির হামজা | ছবি: ফাতেমা তুজ জোহরার কাছ থেকে

মুঠোফোনে ফাতেমা বলেন, আমির হামজা আস্তে আস্তে তাঁকে ভরসা করা শুরু করেন। একসময় জানিয়ে দেন, তিনি ফাতেমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন, বিয়ে করতে চান। পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে কাজি অফিস দেখলেই বিয়ে করতে চাইতেন। আসলে আমির হামজা ভয় পেতেন, ফাতেমাও যদি তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যান। এমনই এক পরিস্থিতিতে তাঁরা গোপনে বিয়ে করেন।

একটু উঁকিঝুঁকি, ভালোবাসার মানুষ দেখা  | ছবি: ফাতেমা তুজ জোহরার কাছ থেকে

ফাতেমা বললেন, ‘শ্বশুর, চাচাশ্বশুরের অনেক বয়স। তাঁরা বিয়েতে ঢাকায় আসতে পারবেন না। তাই আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা সিলেট গিয়েছিলাম বিয়ের জন্য। একটি হোটেলে ছিলাম। বিয়ের আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন শ্বশুর। বিয়ের পর দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর গত অক্টোবরে শ্বশুর মারা যান। তাই বিয়ের ফটোশুটের ছবিগুলোকে ঘটা করে ফেসবুকে দেওয়া হয়নি।’

বিয়ের ছবির সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আলোচনায় এসেছে, সবার নজর কেড়েছে—এটা ভালোলাগার মতো একটি বিষয়। তবে ফাতেমা তুজ জোহরার মূল ভালোলাগাটা অন্য জায়গায়। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী সব সময় বলেন, আমার জন্য তিনি নতুন জীবন পেয়েছেন। আর আমি ভাবি, আমার জন্য একজন হলেও আত্মহত্যা না করে নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছেন। পরিচয়ের পরপর স্বামীর আগের প্রেমিকাকে আবার ফিরে আসার জন্য স্টেশনে বসেই ফোন করেছিলাম। শুরুতে আমি চেয়েছিলাম তাঁদের দুজনকে এক করে দিতে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। আর এখন সব মিলিয়ে আমরা দুজন ভালো আছি। এখনো আমি স্বামীকে আপনি করেই বলি, তিনিও আমাকে আপনি করেই সম্বোধন করেন।’