আম বাগান কেটে মাছ চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। সম্প্রতি চারঘাটে এমন দৃশ্য দেখা যায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আব্দুল কাদের নাহিদ, চারঘাট থেকে: আমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং টানা লোকসানের কারণে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার চাষিরা একের পর এক আমবাগান কেটে ফেলছেন। বাগান কেটে তাঁরা ধান, সবজি ও মাছ চাষে ঝুঁকছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে উপজেলার আমনির্ভর অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আমকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে বাঁচাতে সরকারি উদ্যোগসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন বলে মনে করছেন চাষিরা। যদিও এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে উপজেলা কৃষি বিভাগ। তাদের দাবি, পুরোনো আমগাছে ফলন কম হচ্ছে, এ জন্য অনেক চাষি সেই গাছ কেটে নতুন করে হাইব্রিড জাতের আমবাগান করছেন। বরং কয়েক বছরে আমবাগান ও উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে।

তবে উপজেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যে কৃষি বিভাগের কথার উল্টো চিত্র পাওয়া গেছে। মৎস্য অফিস জানায়, বর্তমানে উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৭২০টি। দুই বছর আগে ছিল প্রায় ৩ হাজার ৫১৫টি। গত দুই বছরে পুকুরের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০৫টি। বর্তমানে উপজেলায় বছরে মাছ উৎপাদিত হয় ৫ হাজার ৫৫০ টন, যা দুই বছর আগে ছিল ৫ হাজার ২০০ টন।

উপজেলার মোহননগর গ্রামের আমচাষি আনিসুর রহমান জানান, তিনি তাঁর ছয় বিঘা জমির আমবাগান থেকে বছরে লাখ টাকা পেলেও পরিচর্যা ও সার-কীটনাশকের খরচ বাদ দিয়ে প্রায় অর্ধেক টাকা ঘরে আনতে পারতেন। আবার কোনো কোনো বছর লোকসানও গুনেছেন। বর্তমানে বাজারে চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় বাগানের টাকায় সংসার চলছে না। অবশেষে তিনি তাঁর বাগান কেটে ফেলে জমিতে ধান ও সবজি চাষ শুরু করেছেন।

আনিসুর রহমান আরও বলেন, ‘আমবাগান করব কোন দুঃখে? ছয় বিঘা জমির প্রায় ৭৮টি আমগাছের সব কটিই কেটে ফেলেছি। আম বেঁচে সার-কীটনাশকের দাম পরিশোধ করতেই শেষ। এখন ফসল উৎপাদন করে নিজেরা খেতে পারব, বিক্রিও করতে পারব।’

আনিসুর রহমান একা নন। আমের জন্য খ্যাত চারঘাট উপজেলার অধিকাংশ ব্যবসায়ী পাঁচ বছর ধরে লোকসান গুনছেন। দুর্যোগ, মহামারি ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে পাশের জেলা নওগাঁয় আমের ব্যাপক চাষাবাদের কারণে দাম পাচ্ছেন না এই উপজেলার কৃষকেরা।

সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বড় বড় বাগান এখন মাঠে পরিণত হয়েছে। সবজি ও মাছের দাম বেশি হওয়ায় কেউ কেউ বাগান কেটে সবজি চাষ করছেন। কেউ আবার করছেন বিভিন্ন জাতের অসময়ের ফল ও হাইব্রিড আম চাষ। পুকুর কেটে মাছ চাষ শুরু করতেও দেখা গেছে চাষিদের।

উপজেলার রাওথা গ্রামের আমচাষি রফিকুল ইসলাম জানান, বাগান পরিচর্যার খরচ বেশি হওয়ায় এবং কয়েক বছর ধরে আমের ন্যায্য দাম না পেয়ে তিনি তাঁর চার বিঘা বাগানের আমগাছ কেটে ফেলেছেন। ওই জমি বিঘা হিসেবে বছরে ২০ হাজার টাকা করে এক মাছচাষিকে বর্গা দিয়েছেন। বাগানের জমিতে এখন মাছ চাষ হচ্ছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা আম চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও তরুণ উদ্যোক্তা হামিদুর সরকার জানান, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অর্থকরী ফসল আমকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এ জন্য দেশের বাইরে আম রপ্তানি বাড়াতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে হলে পরিবহন খরচ কমাতে হবে। আম থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার উৎপাদনে শিল্পোদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমের চাহিদা বাড়বে। কৃষকেরা আমের ন্যায্যমূল্য পাবেন। নয়তো আমবাগান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানান, উপজেলায় শুধু পুরোনো বড় বড় আমগাছ কাটা হচ্ছে। আমবাগান কাটা হলেও সেসব স্থানে লাগানো হচ্ছে নতুন হাইব্রিড জাতের আমগাছ। এতে পরিকল্পিতভাবে নতুন নতুন আমবাগান গড়ে উঠছে, তাতে আম চাষ ও উৎপাদন—দুই-ই বেড়েছে। চাষিরা যেন আমের ন্যায্য দাম পান, সে জন্যও কৃষি বিভাগ কাজ করছে।