রেলওয়ে ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন। ছবিটি সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ: কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনায় বিড়ম্বনার বাহনে পরিণত হয়েছে সিরাজগঞ্জ-ঢাকা রুটে চলাচলকারী একমাত্র আন্তঃনগর ট্রেন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। সড়কপথে যানজট এড়াতে ট্রেনে ভ্রমণ করা যাত্রীদের পথে পথে পড়তে হচ্ছে নানা দুর্ভোগে। একাধিক স্টেশনে ক্রসিং-বিরতি লোকাল ট্রেনকেও হার মানিয়েছে। তিন ঘণ্টার পথ যেতে সময় লাগছে ছয় থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা।

সম্প্রতি ট্রেনটিতে ভ্রমণ করা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসে আর আন্তঃনগর ট্রেনের সেবা নেই। ট্রেনটি সিরাজগঞ্জবাসীর কোনো কাজেই আসছে না।

কাপড় ব্যবসায়ী শান্ত মির্জা, ব্যবসায়ী শাহজামাল, চাকরিজীবী তানজিম আহমদসহ একাধিক যাত্রীর অভিযোগ, নির্দিষ্ট সময়ে কোনোদিনই ট্রেনটি পৌঁছাতে পারে না। ট্রেনটিকে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে একাধিক ট্রেনের ক্রসিং করানোর ফলে যাত্রী দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। এ ছাড়া নেই কোনো এসি-বগি। একটিমাত্র শোভন চেয়ারকোচ, সেখানেও আসন পাওয়া যায় না।

খলিলুর রহমান চৌধুরী নামের এক যাত্রী বলেন, ‘স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের জন্য পরিবারসহ ট্রেনে উঠেছি। কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য তো দূরের কথা, লোকাল ট্রেনের চেয়েও বেশি সময় লাগছে।’

ট্রেনটির পাওয়ার কার ইঞ্জিনিয়ার রেজাউল করিম নিজেও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ পথে বেশিরভাগ ট্রেনের ক্রসিংয়ের জন্য সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসকেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’

চালক শামছুল আলম বলেন, ‘স্টেশনে স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানোর জন্য আমাদের কিছু করার নেই। পাকশী কন্ট্রোলার এটি নিয়ন্ত্রণ করেন।’

জানা যায়, একসময়ের রেলসিটি সিরাজগঞ্জ ধীরে ধীরে রেলশূন্য হয়ে পড়েছিল। রাজশাহীমুখী একটি লোকাল ট্রেন ছাড়া আর কোনো ট্রেন ছিল না। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১৩ সালে সিরাজগঞ্জ থেকে সরাসরি ঢাকায় যাতায়াতে আন্তঃনগর ট্রেন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস চালু হয়। ট্রেনটি সকাল ৬টায় ছেড়ে ১০টায় ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। ফলে কর্মজীবীরা অফিস ধরতে পারবেন এবং বিকেল ৫টায় অফিস শেষে ওই ট্রেনযোগেই ফিরতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছিল।’

২০২০ সালে করোনা নিষেধাজ্ঞায় অন্যান্য ট্রেনের মতো সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসও বন্ধ হয়ে যায়। পরে সারা দেশে ট্রেন যোগাযোগ চালু হলেও সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস চালু হয় না। শহরবাসীর আন্দোলনের ফলে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে পুরোনো কিছু কোচ নিয়ে আবারও চালু হয় এ ট্রেন। কিন্তু যাত্রীসেবার মান নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। সকাল ৬টায় ছেড়ে যাওয়া ট্রেন ঢাকায় পৌঁছায় সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টায়। অর্থাৎ পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা লেগে যায়। একই অবস্থা দাঁড়ায় ফিরতি ট্রেনেও।

সিরাজগঞ্জ বাজার রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারী মাসুদ রানা বলেন, ‘ট্রেনটির সাড়ে তিনশ আসনের মধ্যে সিরাজগঞ্জ, রায়পুর, জামতৈল, শহীদ মনসুর আলী ও বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম—এ পাঁচটি স্টেশনের জন্য বরাদ্দ ২০০টি। বাকি আসন টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার জন্য বরাদ্দ। প্রায় আড়াই মাস আগে এই ট্রেনের একটি চেয়ারকোচ নষ্ট হয়ে যায়। সেটি মেরামত করে আর দেওয়া হয়নি। সম্ভবত বগিটি অন্য কোনো ট্রেনে সংযোজন করা হয়েছে।’

ট্রেনটির ব্যাপারে কারও গরজ নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘স্টেশনে টিকিট ফুরিয়ে গেছে। টিকিটও দেওয়া হচ্ছে না। হাতে লিখে যাত্রীদের টিকিট দিতে হচ্ছে।’

সদ্য অবসরে যাওয়া রায়পুর স্টেশন মাস্টার গোলাম হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে ট্রেনটিতে একটি পাওয়ার কার, একটি ইঞ্জিন ও ছয়টি বগি রয়েছে। কোনো এসি-কোচ নেই। শোভন চেয়ার একটি, প্রথম শ্রেণি একটি ও চারটি সাধারণ বগি রয়েছে।’

সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বলেন, ‘প্রথমে পুরোনো কোচ দিয়ে চালু হলেও পরে ট্রেনটিতে এসি-কোচ, কেবিনসহ নতুন বগি সংযোজন করা হয়েছিল। করোনার পর ট্রেনটি পুরোনো কিছু কোচ দিয়ে চালু করা হলেও যাত্রীসেবায় সিরাজগঞ্জবাসীর সঙ্গে চরম প্রতারণা করা হয়েছে।’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় ট্রান্সপোর্টেশন অফিসার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘উত্তরাঞ্চল-ঢাকা রুটে প্রতিদিন প্রায় ৪২টি ট্রেন চলাচল করে। সিঙ্গেল রুটে এত ট্রেন চলাচলের কারণে ক্রসিং হতে পারে। ডাবল লেন হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মো. কুদরত-এ খোদা বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসের একটি কোচ ড্যামেজ হয়েছিল। আমরা এটি মেরামত করে ট্রাফিক বিভাগকে দিই। তারা চাহিদা অনুযায়ী বগিটি সংযোজন করে।’